
সৈয়দ মুজিবুর রহমান দুলাল, লাকসামঃ কুমিল্লার লাকসামে ইক্বরা মহিলা মাদ্রাসায় সপ্তম শ্রেণির এক আবাসিক শিক্ষার্থীর মৃত্যু ঘিরে ধুম্রজাল ও চাঞ্চল্যের সৃষ্টি হয়েছে। গত ১০ দিনেও মৃত্যুর রহস্য উদঘাটন করতে পারেনি পুলিশ। নিহত শিক্ষার্থীর নাম সামিয়া আক্তার (১৩)। সে নাঙ্গলকোট পৌরসভার ২ নম্বর ওয়ার্ডের নাওগোদা গ্রামের সৌদি আরব প্রবাসী মো. নিজাম উদ্দিনের মেয়ে।
গত শুক্রবার (১৮ এপ্রিল) রাজধানী ঢাকার একটি বেসরকারি হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় ওই শিক্ষার্থী মারা যায়। আগেরদিন বৃহস্পতিবার (১৭ এপ্রিল) দিবাগত রাত তিনটার দিকে মাদ্রাসার পাশে লাকসাম পৌরসভা সড়কে ওপর থেকে আহত অবস্থায় স্থানীয় লোকজন তাকে উদ্ধার করেন।
নিহত ওই শিক্ষার্থীর স্বজনদের অভিযোগ মাদ্রাসা কর্তৃপক্ষ পরিকল্পিভাবে তাকে হত্যা করেছে। তবে এ অভিযোগ অস্বীকার করেছেন মাদ্রাসা কর্তৃপক্ষ। তাঁরা বলছেন মাদ্রাসা থেকে পালানোর সময় ওই শিক্ষার্থী দুর্ঘটনার শিকার হয়। পরে চিকিৎসাধীন অবস্থায় মারা গেছে।
নিহতের স্বজন ও মাদ্রাসা কর্তৃপক্ষের পরস্পর বিরোধী বক্তব্যে এবং উদ্ধারকৃত স্থানীয়দের মন্তব্যে ওই শিক্ষার্থীর মৃত্যু নিয়ে ধুম্রজাল সৃষ্টি হয়েছে।
এদিকে সামিয়ার মৃত্যুর রহস্য ও সঠিক কারণ উদঘাটনের দাবি জানিয়ে গত বৃহস্পতিবার (২৪ এপ্রিল) লাকসাম ও নাঙ্গলকোটে মানববন্ধন ও বিক্ষোভ সমাবেশ করেছেন নিহত সামিয়ার পরিবার, বৈষম্য বিরোধী ছাত্র আন্দোলন, শিক্ষার্থী এবং বিভিন্ন শ্রেণি-পেশার মানুষ।
ঘটনারদিন আহত ওই শিক্ষার্থীকে উদ্ধার করে হাসপাতালে নেওয়া নুরে আলম নামে স্থানীয় এক ব্যক্তি জানান, ওইদিন রাত ৩:০৯ মিনিটে সময় তিনিসহ আরো ৫/৬জনে মিলে সড়কের ওপর চিৎ হয়ে পড়ে থাকা ওই শিক্ষার্থীকে উদ্ধার করেছেন। এ সময় ওই শিক্ষার্থীর পাশে একটি ব্যাগ পড়ে পড়েছিলো। আশ্চর্য ব্যাপার হচ্ছে তার শরীর থেকে একফোটা রক্ত বের হতেও দেখলাম না। পুরো শরীর অক্ষত!
তিনি জানান, ওই সময় মেয়েটি কিছু কথা বলতে চেয়েছেন। কিছু কথা বলেছেনও। যা লাকসামে সংশ্লিষ্ট হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় কর্তব্যরত নার্স’র বা কর্তৃপক্ষের নিকট ওডিও বা ভিডিও রেকর্ড থাকতে পারে।
পুলিশ, নিহত শিক্ষার্থীর স্বজন ও মাদ্রাসা কর্তৃপক্ষ সূত্রে জানা গেছে, গত ১৫ মার্চ সামিয়াকে ওই মাদ্রাসায় (আবাসিকে) সপ্তম শ্রেণিতে ভর্তি করা হয়। গত ১৩ এপ্রিল সামিয়াকে বাড়ি নিতে তার বড় বোন এবং খালা মাদ্রাসায় আসেন। কিন্তু মাদ্রাসা প্রধান মো. জামাল উদ্দিন তাকে ছুটি দেননি। ছুটি না দেওয়ায় সে কান্নাকাটি শুরু করে। এ সময় সামিয়ার বড় বোন ও খালা তাকে নিতে চাইলে দু’জন মহিলা শিক্ষক সামিয়াকে উপরে শ্রেণি কক্ষে নিয়ে যায়। এ সময় সামিয়া আরো জোরে কান্না করতে থাকে।
সামিয়ার বড় বোন নাজমিন আক্তার ও খালা রাবেয়া বেগম জানান, সামিয়ার কান্নাকাটি দেখে তাঁরা মাদ্রাসা প্রধানের নিকট ছুটির আবেদন জানিয়ে তাকে নিতে চাইলে তিনি ছুটি তো দেনই নাই। উপরন্ত তাঁদের ধমক দিয়ে মাদ্রাসা থেকে বের হয়ে যেতে বলেন। একপর্যায়ে ওই মাদ্রাসার দারোয়ান খলিলুর রহমানের তাঁদের ধাক্কা দিয়ে বের করে দেন।
ওই মাদ্রাসার প্রধান মো. জামাল উদ্দিন এ অভিযোগ অস্বীকার করে বলেন, ঈদের ছুটির পর সপ্তাহখানেক আগে ওই শিক্ষার্থীর নিয়মিত ক্লাস শুরু হয়। তবে সে মাদ্রাসার আবাসিকে থাকতে সে অনাগ্রহী ছিলো।
তিনি জানান, বৃহস্পতিবার (১৭ এপ্রিল) রাতে ওই শিক্ষার্থী তার মাকে ফোন দেয় এবং বাড়ি যাওয়ার ইচ্ছা প্রকাশ করে। গভীর রাতে মাদ্রাসার একটি জানালার গ্রীলের ফাঁকা জায়গা দিয়ে পালাতে গিয়ে নিচে পড়ে আহত হয়। এমতবস্থায় স্থানীয় লোকজন দেখে আমাকে মুঠোফোনে অবহিত করলে আমিসহ অন্যান্যরা তাকে উদ্ধার করে স্থানীয় একটি হাসপাতালে নিয়ে যাই। পরে চিকিৎসকের পরামর্শে উন্নত চিকিৎসার জন্য ঢাকায় পাঠানো হয়। সেখানে একটি বেসরকারি হাসপাতালে ভর্তি করা হলে চিকিৎসাধীন অবস্থায় শুক্রবার (১৮ এপ্রিল) দুপুর সাড়ে ১২টার দিকে সে মারা যায়।
নিহত সামিয়ার মা শারমিন আক্তারেে অভিযোগ, মাদ্রাসা কর্তৃপক্ষ মিথ্যা ও ভিত্তিহীন কথা বলে শাক দিয়ে মাছ ঢাকার চেষ্টা করছে। তাঁর মেয়েকে পরিকল্পিত ভাবে হত্যা করা হয়েছে বলে তিনি দাবি করেন।
তাঁর অভিযোগ, মাদ্রাসা কর্তৃপক্ষ ঘটনাটি মিমাংসার করতে কতিপয় রাজনৈতিক নেতাদের মধ্যস্থতায় সামাজিক ভাবে সমঝোতার জন্য চাপ দিচ্ছেন।
নিহত সামিয়ার সর্ম্পকিত চাচা সাইদুল হাসান সৈকত জানান, পাঁচতলা থেকে একটি শিশু আরসিসি ঢালাই পাকা রাস্তায় ওপর পড়লে বেঁচে থাকার কথা নয়। তার হাড়গোড় ভেঙ্গে ঘটনাস্থলেই মারা যাওয়ার কথা। কিন্তু সেখানে আমি তার শরীর থেকে একফোটা রক্ত পর্যন্ত বের হতে দেখিনি।
এদিকে ঘটনার অনুসন্ধানে সরেজমিনে ওই মাদ্রাসায় গিয়ে দেখা গেছে, পাঁচতলা ভবনটির অজুখানার পাশে একটি জানালা। ওই জানালার দু’টি গ্রীলের মধ্যখানে ৬ইঞ্চি পরিমান ফাঁকা। ওই ফাঁকা স্থান দিয়ে একজন মানুষ বই-খাতা, কাপড়-চোপড়ের একটি ব্যাগ নিয়ে বের হওয়া অনেক কষ্টসাধ্য। নীচে আরসিসি ঢালাই সড়ক এবং আরসিসি ঢালাই নালার ওপর আরসিসি ঢালাই স্ল্যাব। পাশে বৈদ্যূতিক খাম। ওপরে ৪৪০ ভোল্টের বিদ্যূতের সচল লাইন। এমতবস্থায় প্রায় ৫০ ফুট ওপর থেকে ১৩ বছরের একজন শিশু নীচে পড়লো। কিন্তু একফোটা রক্ত বের হলো না! কোথাও ভাংগলো না! বিষয়টি অত্যন্ত রহস্যজনক বলে মনে করছেন অভিজ্ঞমহল।
স্থানীয় একাধিক ব্যক্তি বলেন, মাদরাসা কর্তৃপক্ষের ভাষ্যমতে পাঁচতলা ভবনের জানালার একটি ফাঁকা জায়গা দিয়ে ওই শিক্ষার্থী পালাতে গিয়ে নিচে পড়ে আহত হয়েছে। এটিকেও যদি সত্য বলে মনে করি। তাহলেও এ ক্ষেত্রেও মাদ্রাসা কর্তৃপক্ষ কোনোভাবেই দায় এড়াতে পারেন না। তাঁদের গাফিলতির কারণেই এই মর্মান্তিক ঘটনাটি ঘটেছে।
নাম প্রকাশ না করার শর্তে ওই মাদ্রাসার অনেক শিক্ষার্থীর অভিভাবক অত্যন্ত উদ্বেগ জানিয়ে বলেন, মাদ্রাসা কর্তৃপক্ষের গাফিলতি ও উদাসীনতায় এভাবে আর কতো শিক্ষার্থীর অকালে জীবন ঝরবে!
এখানে উল্লেখ্য যে, ২০২১ সালে মনোহরগঞ্জের লক্ষণপুর ইউনিয়নের বানঘর গ্রামের নুসরাত নামে ওই মাদ্রাসার ১০ বছর বয়সী অপর এক শিক্ষার্থী রান্না করা গরম ডালের পাতিলে পড়ে ঝলসে গিয়ে গুরুতর আহত হয়। কয়েকদিন পর চিকিৎসাধীন সে মারা যায়।
অভিযোগ রয়েছে, মাদ্রাসা কর্তৃপক্ষ মোটা অংকের টাকার বিনিময়ে তৎকালীন আওয়ামীলীগ নেতাদের দিয়ে ওই ঘটনাটি রফাদফা করেন।
এই ব্যাপারে ইক্বরা মহিলা মাদ্রাসার প্রধান মো. জামাল উদ্দিন নিজেদের গাফিলতির দায় স্বীকার করে জানালার গ্রীলের ফাঁকা সম্পর্কে বলেন, এটি আগে আমার নজরে আসেনি। এ ছাড়া, ২০২১ সালে নুসরাতের মৃত্যুর বিষয়টির সত্যতা নিশ্চিত করে বলেন, এটি ছিলো নিছক একটি একটি দুর্ঘটনা। তবে সামাজিক সমঝোতার মাধ্যমে ওই সময় ঘটনাটি নিষ্পত্তি হয়েছে।
এদিকে নিহত সামিয়ার মা শারমিন আক্তার এ ঘটনায় সুষ্ঠু তদন্তের মাধ্যমে মৃত্যুর সঠিক কারণ উদঘাটনসহ সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের নিকট ন্যয় বিচারের দাবি জানিয়েছেন।
এই ব্যাপারে লাকসাম থানার অফিসার ইনচার্জ (ওসি) নাজনীন সুলতানা বলেন, এ ঘটনায় নিহত ওই শিক্ষার্থীর মামা নাছির উদ্দিন থানায় একটি অপমৃত্যু মামলা রুজু করেছেন।
ওসি আরো বলেন, ঘটনাটি অত্যন্ত স্পর্শকাতর। পুলিশ ঘটনাস্থল পরিদর্শন করেছে। ময়নাতদন্তের প্রতিবেদন পাওয়া সাপেক্ষ প্রয়োজনীয় আইনগত ব্যবস্থা নেওয়া হবে। তদন্ত অব্যাহত রয়েছে।