
নির্বাচন ডিসেম্বরের মধ্যেই করতে হবে, না হলে এই দেশের ভৌগোলিক অখণ্ডতা ঠিক থাকবে না: মির্জা আব্বাস
জাতীয় নির্বাচন নিয়ে ফের জটিলতা দেখা দিয়েছে। অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূস সম্প্রতি জাপানে একটি আন্তর্জাতিক ফোরামে দেওয়া বক্তব্যে বলেছেন, “নির্বাচন বছরের শেষে ডিসেম্বর অথবা সর্বোচ্চ জুনে অনুষ্ঠিত হতে পারে।” তার এই মন্তব্যকে কেন্দ্র করে রাজনীতিতে নতুন বিতর্কের সৃষ্টি হয়েছে।
বিএনপি এবং তাদের মিত্র রাজনৈতিক দলগুলো বলছে, নির্বাচন ডিসেম্বরের মধ্যেই হওয়া উচিত। অথচ প্রধান উপদেষ্টার বক্তব্যে জুন পর্যন্ত সময়ের ইঙ্গিত পাওয়া গেছে, যা রাজনৈতিক অঙ্গনে প্রশ্ন তুলেছে সরকারের নিরপেক্ষতা নিয়েও।
বৃহস্পতিবার জাপানের টোকিওতে আয়োজিত ‘নিক্কেই ফোরাম ফর ফিউচার অব এশিয়া’ অনুষ্ঠানে ইউনূস বলেন, “সব রাজনৈতিক দল নয়, একটি দলই ডিসেম্বরের মধ্যে নির্বাচন চায়।” এই বক্তব্যে বিএনপি ক্ষোভ প্রকাশ করেছে।
বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য মির্জা আব্বাস বলেছেন,
“ড. ইউনূস জাপানে বসে বিএনপির বদনাম করেছেন। লজ্জাও পেলেন না দেশের সম্পর্কে বিদেশে এমন মন্তব্য করতে! তিনি নিজেই আগে বলেছেন, ডিসেম্বরের মধ্যে নির্বাচন হতে হবে। এখন আবার জুন বলছেন। এটা জাতির সঙ্গে প্রতারণা। নির্বাচন ডিসেম্বরের মধ্যেই করতে হবে, না হলে এই দেশের ভৌগোলিক অখণ্ডতা ঠিক থাকবে না।”
বিএনপি বলছে, তারা শুধু নয়, অধিকাংশ বিরোধী দলই ডিসেম্বরের মধ্যে নির্বাচন চায়। অথচ প্রধান উপদেষ্টার বক্তব্যে তার বিপরীত প্রতিচ্ছবি পাওয়া গেছে।
নাগরিক ঐক্যের সভাপতি মাহমুদুর রহমান মান্না বলেন,
“ডিসেম্বরে নির্বাচনের অসুবিধা কী? আমরা বলেছি হওয়া উচিত, জোর দাবি তুলিনি। বিএনপি তুলেছে। দেশের অর্ধেকের বেশি রাজনৈতিক শক্তি তো বিএনপির সঙ্গে। প্রধান উপদেষ্টা কেন এমন বক্তব্য দিলেন, বুঝতে পারছি না।”
বিএনপির স্থায়ী কমিটির আরেক সদস্য সালাহউদ্দিন আহমেদ বলেন,
“প্রধান উপদেষ্টা বলেছেন, তাড়াহুড়ো করে সংস্কার করতে হলে ডিসেম্বরের মধ্যে নির্বাচন সম্ভব নয়। আমরা বলি, আপনার উপদেষ্টা পরিষদ সংস্কার করুন। সেখানে যারা আছে, তারা নিরপেক্ষ নন। বিতর্কিত ভূমিকার কারণে রাজনৈতিক দূরত্ব বেড়েছে।”
প্রধান উপদেষ্টার বক্তব্যে হতাশ রাজনৈতিক দলগুলো
প্রধান উপদেষ্টার বক্তব্যে রাজনৈতিক জোটগুলোও হতাশা প্রকাশ করেছে।
বিপ্লবী ওয়ার্কার্স পার্টির সাধারণ সম্পাদক সাইফুল হক বলেন,
“প্রধান উপদেষ্টা বলছেন, সবাই জুনে নির্বাচন চায়। বাস্তবতা উল্টো। দুই-একটা দল ছাড়া সবাই ডিসেম্বরেই নির্বাচন চায়। তার বক্তব্যে সময় বাড়ানোর যৌক্তিক ব্যাখ্যা নেই। বরং আশঙ্কা জাগছে, এর পেছনে কোনো গোপন এজেন্ডা আছে কি না।”
গণসংহতি আন্দোলনের প্রধান সমন্বয়কারী জোনায়েদ সাকি বলেন,
“সব দলই বলেছে দ্রুত সংস্কার শেষে নির্বাচন দিতে। সরকারই বলেছে জুনে হবে। তাহলে ব্যাখ্যা সরকারেরই দেওয়া উচিত।”
ইসলামী আন্দোলনের যুগ্ম মহাসচিব মাওলানা গাজী আতাউর রহমান বলেন,
“নির্বাচন যেনতেনভাবে নয়। জনগণ রক্ত দিয়েছে। তাই আগে সংস্কার, পরে নির্বাচন। সময় বেঁধে দিয়ে নয়, মৌলিক সংস্কার শেষে নির্বাচন হওয়া উচিত।”
হেফাজতে ইসলামের যুগ্ম মহাসচিব মাওলানা আজিজুল হক ইসলামাবাদী বলেন,
“আমরা রমজানের পর নির্বাচন বলেছিলাম। বিএনপি চায় ডিসেম্বরে। আলোচনার মাধ্যমে সিদ্ধান্তে আসা উচিত। দ্রুত রোডম্যাপ দিয়ে নির্বাচন হোক, সেটা আগে বা পরে—যেটাই হোক।”
জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দল (জেএসডি)-এর সাধারণ সম্পাদক শহীদ উদ্দিন মাহমুদ স্বপন বলেন,
“সংস্কার, বিচার ও নির্বাচনের সুনির্দিষ্ট রোডম্যাপ দরকার। ডিসেম্বরে হলে ভালো। জানুয়ারিতেও সম্ভব হলে রোডম্যাপ অনুযায়ী করতে হবে।”
রাজনৈতিক অস্থিরতার মাঝেই চলছে বৈঠক ও চাপা উত্তেজনা
গত শনিবার ড. ইউনূসের সঙ্গে বৈঠক করে বিএনপি নির্বাচন রোডম্যাপ ঘোষণার দাবি জানায়। ওইদিন জামায়াত ও জাতীয় নাগরিক পার্টির (এনসিপি) সঙ্গেও বৈঠক হয়। রোববার আরও ১৯টি দলের সঙ্গে প্রধান উপদেষ্টার বৈঠকের পর রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা মনে করেছিলেন, দেশ কিছুটা স্থিতিশীলতার দিকে যাবে। কিন্তু তার পরের বৃহস্পতিবারের বক্তব্যে নতুন করে রাজনৈতিক অস্থিরতা তৈরি হয়েছে।
সারসংক্ষেপ:
ড. মুহাম্মদ ইউনূসের ‘ডিসেম্বর অথবা জুন’ মন্তব্যে রাজনৈতিক অঙ্গনে সন্দেহ ও উত্তেজনা দেখা দিয়েছে। বিরোধীদলগুলো বলছে, সময় বাড়িয়ে নির্বাচন পেছাতে চাইছে সরকার। তারা ডিসেম্বরে নির্বাচনের পক্ষেই অনড়। প্রয়োজনীয় সংস্কার দ্রুত শেষ করে সঠিক সময়ে নির্বাচনের দাবিতে সরব হয়ে উঠেছে সমমনা জোটগুলো।