দিনাজপুরের নবাবগঞ্জ উপজেলার মাহমুদপুর ইউনিয়নের হরিনাথপুর রাজবাড়ি গ্রামে ৬০০ বছরের পুরোনো একটি পুকুরে খননকাজ চলাকালে মিলেছে দুটি প্রাচীন মূর্তি। দীর্ঘকাল শুকিয়ে না যাওয়া এই পুকুর প্রথমবারের মতো সেচে শুকিয়ে তলদেশ খননের সময় সোমবার ও মঙ্গলবার (দুই দিনে) পাওয়া যায় এসব মূর্তি। ধারণা করা হচ্ছে, মূর্তিগুলো কষ্টিপাথরের তৈরি।

পুকুরটির মালিক স্থানীয় বাসিন্দা আনিছার রহমান (৫৭)। প্রায় ৩.৯৪ একর আয়তনের এই পুকুর ‘বড়দিঘি’ নামে পরিচিত।
স্থানীয়রা জানান, সংস্কারের উদ্দেশ্যে আনিছার রহমান পুকুরটি সেচে শুকিয়ে খননযন্ত্র দিয়ে কাজ শুরু করেন। সোমবার বিকেলে খননের সময় পুকুরের তলদেশ থেকে উঠে আসে একটি বিষ্ণুমূর্তি। উচ্চতা ২৯ ইঞ্চি, প্রস্থ ১৩ ইঞ্চি এবং ওজন ২৭ কেজি। খবর পেয়ে উপজেলা প্রশাসন মূর্তিটি উদ্ধার করে দিনাজপুর জেলা ট্রেজারিতে জমা দেয়। পরদিন মঙ্গলবার আরও একটি নারীমূর্তি উদ্ধার করা হয়। সেটির উচ্চতা ২৪ ইঞ্চি, প্রস্থ ১০ ইঞ্চি এবং ওজন ১৭ কেজি। এই মূর্তিটি বর্তমানে নবাবগঞ্জ থানার মালখানায় রয়েছে।
পুকুরটির মালিক আনিছার রহমান জানান, তাঁর পূর্বপুরুষদের কাছ থেকে শোনা, ১৪০০ সালের দিকে হরিনাথপুরে রাজা গণেশ নামের এক জমিদার ছিলেন। তাঁর রাজবাড়ির চারপাশে ২৫০ থেকে ৩৫০ মিটার দূরত্বে ছিল চারটি বড় পুকুর—বড়দিঘি (১২ বিঘা), নলতাহার (৯ বিঘা), তকবিল (৬ বিঘা) ও পীরপুকুরিয়া (৬ বিঘা)। যদিও রাজবাড়ির কোনো স্থাপনা এখন নেই, তবে ওই এলাকায় খনন করলে চ্যাপ্টা ইট ও সুরকির গাঁথুনি মেলে।
স্থানীয় জনশ্রুতি অনুযায়ী, রাজা গণেশ চণ্ডীদেবীর ভক্ত ছিলেন এবং বিষ্ণুভক্ত ব্রাহ্মণদের কাছে পুণ্যলাভের আশায় চরণপূজা করতেন। ধারণা করা হয়, তিনি তাঁর রাজবাড়ি সংলগ্ন মন্দিরে এই মূর্তিগুলো রেখেছিলেন।
১৯৭৩ সালে রাজবাড়ির জমির এক অংশ দান করে হরিনাথপুর হারেছ উদ্দিন সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা করা হয়। এরপর ১৯৯৫ সালে সেখানে উচ্চবিদ্যালয় গড়ে ওঠে।
গ্রামের আরেকজন প্রবীণ বাসিন্দা এনামুল ইসলাম জানান, ১৯৪০ সালের আগ পর্যন্ত গ্রামে রাজা গণেশের পরিবার ছাড়া অন্য কেউ থাকতেন না। পরে নোয়াখালী থেকে কিছু মানুষ এসে বসতি স্থাপন করেন।
পুকুরটিকে ঘিরে নানা গল্প প্রচলিত আছে। একসময় ভয় ও রহস্যে ঘেরা এই পুকুরে কেউ গোসল করতেন না। পায়ে শিকল বা শক্ত কিছু লাগার অনুভূতি পাওয়া যেত। বিশালাকৃতির মাছও দেখা যেত এখানে।
নবাবগঞ্জ থানার ওসি মোহাম্মদ আবদুল মতিন জানান, উদ্ধার হওয়া দুটি মূর্তি কষ্টিপাথরের বলে ধারণা করা হচ্ছে। একটি ইতোমধ্যে ট্রেজারিতে জমা দেওয়া হয়েছে, অন্যটির বিষয়ে আদালতের নির্দেশনার অপেক্ষা চলছে।
রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের ইতিহাস বিভাগের সাবেক অধ্যাপক ও হেরিটেজ আর্কাইভসের পরিচালক মাহবুবর রহমান জানান, মূর্তিগুলো রাজা গণেশের আমলেরও হতে পারে, আবার পালযুগেরও হতে পারে। বরেন্দ্র অঞ্চলে এমন মূর্তি প্রায়ই পাওয়া যায়। ১৯১১ সাল থেকে এসব মূর্তি বরেন্দ্র গবেষণা জাদুঘরে সংরক্ষিত হয়ে আসছে। যেহেতু মূর্তিগুলো দিনাজপুর থেকে উদ্ধার হয়েছে, সেগুলো দিনাজপুরেই রাখা উচিত বলেও মত দেন তিনি। এজন্য দিনাজপুর জাদুঘরের কিউরেটরের সঙ্গে যোগাযোগ করার পরামর্শ দেন তিনি।