Friday, August 1
Shadow

মহাবিশ্বের আয়ুষ্কাল ৩৩.৩ বিলিয়ন বছর, আবার ফিরে যাবে এক বিন্দুতে: দাবি গবেষকদের

মহাবিশ্ব হয়তো চিরকাল বিস্তৃত হতে থাকবে না, যেমনটা বিজ্ঞানীরা আগে ভেবেছিলেন। পৃথিবীর সবচেয়ে বড় দুটি জ্যোতির্বিজ্ঞান গবেষণা প্রকল্প — ডার্ক এনার্জি সার্ভে (DES) এবং ডার্ক এনার্জি স্পেকট্রোস্কোপিক ইনস্ট্রুমেন্ট (DESI) — থেকে পাওয়া নতুন তথ্য বলছে, ‘ডার্ক এনার্জি’ নামে পরিচিত সেই রহস্যময় শক্তি হয়তো পরিবর্তিত হচ্ছে।

এই পরিবর্তন যদি সত্য হয়, তাহলে এর ফলাফল হতে পারে মারাত্মক। অর্থাৎ, মহাবিশ্ব হয়তো চিরদিনের জন্য বিস্তৃত হবে না, বরং এক সময় তা সংকুচিত হতে শুরু করবে। বিজ্ঞানীরা এখন বিশ্বাস করছেন, সম্পূর্ণ উল্টো একটি প্রক্রিয়া আগামী ১০ বিলিয়ন (১০০০ কোটি) বছরের মধ্যেই শুরু হতে পারে, যার শেষ হবে ‘বিগ ক্রাঞ্চ’ নামে পরিচিত একটি মহা-সংকোচনের মাধ্যমে।

এই সিদ্ধান্ত এসেছে এক নতুন তাত্ত্বিক গবেষণা থেকে, যা এখনো প্রাক-প্রকাশিত পর্যায়ে রয়েছে এবং পিয়ার রিভিউয়ের (সহকর্মী যাচাই) অপেক্ষায় আছে। এই গবেষণাটি মহাজাগতিক শক্তিগুলোর কাজের পদ্ধতি নিয়ে এক সাহসী পুনর্ব্যাখ্যা উপস্থাপন করেছে।

নতুন মডেলটি কী প্রস্তাব করছে

বহু বছর ধরে পদার্থবিজ্ঞানীরা ধরে নিয়েছিলেন, ডার্ক এনার্জি একটি নিরবিচারে ও ধ্রুবক শক্তি — যেটাকে আইনস্টাইনের সাধারণ আপেক্ষিকতার সূত্রে ‘কসমোলজিক্যাল কনস্ট্যান্ট’ নামে ব্যাখ্যা করা হয়। কিন্তু নতুন বিশ্লেষণ সেই ধারণাকে চ্যালেঞ্জ জানাচ্ছে।

Space.com-এ প্রকাশিত এক প্রতিবেদনে বলা হয়, এই নতুন গবেষণায় ডার্ক এনার্জির পেছনে দুটি উপাদানের কথা বলা হয়েছে: একটি হলো কসমোলজিক্যাল কনস্ট্যান্ট এবং অন্যটি একটি কণিকা — অ্যাক্সিয়ন নামে পরিচিত। অ্যাক্সিয়ন হলো একটি কাল্পনিক, অতিক্ষুদ্র কণিকা, যা খুবই কম পরিমাণে অন্যান্য বস্তুদের সঙ্গে বিক্রিয়া করে। তবুও ধারণা করা হয়, এই কণিকাগুলো মহাবিশ্ব জুড়ে ছড়িয়ে থাকতে পারে এবং বর্তমানে যে দ্রুত সম্প্রসারণ হচ্ছে, তার অনেকটাই এর কারণে হতে পারে।

অন্যদিকে, কসমোলজিক্যাল কনস্ট্যান্ট হলো ফাঁকা স্থানে থাকা একটি নির্দিষ্ট শক্তির মান। কিন্তু এই নতুন মডেলে বলা হচ্ছে, এই মানটি ধনাত্মক নয় — বরং ঋণাত্মক।

গবেষক দল তাদের ব্যাখ্যা স্পষ্টভাবে দিয়েছেন: “আমরা এখন যে দ্রুত সম্প্রসারণের যুগে বসবাস করছি, তা একটি সাময়িক সময়। এবং এটি মূলত অ্যাক্সিয়ন ক্ষেত্র দ্বারা চালিত।”

এই মুহূর্তে মহাবিশ্বের সম্প্রসারণের মূল শক্তি হিসেবে কাজ করছে অ্যাক্সিয়ন। কিন্তু সময়ের সঙ্গে সঙ্গে, এই কণিকাগুলোর প্রভাব কমে যাবে। তখন ঋণাত্মক কসমোলজিক্যাল কনস্ট্যান্ট নিয়ন্ত্রণ নিতে শুরু করবে। এর ফলে মহাবিশ্বের সম্প্রসারণ ধীরে ধীরে কমে আসবে।

এক পর্যায়ে, সম্প্রসারণ পুরোপুরি থেমে যাবে — এবং উল্টো দিকে ফিরে যাবে।

বিগ ক্রাঞ্চ: বিগ ব্যাংয়ের উল্টো রূপ

এরপর কী হবে? এই মডেল অনুযায়ী, তখন মহাকর্ষ (গ্র্যাভিটি) মহাবিশ্বকে আবার নিজের দিকে টানতে শুরু করবে। গ্যালাক্সিগুলো একে অপরের দিকে ছুটে আসবে, একীভূত হবে, এবং পরস্পরের সঙ্গে সংঘর্ষে ধ্বংস হয়ে যাবে। তাপমাত্রা বাড়বে। স্থান ক্রমে ছোট, উত্তপ্ত ও ঘন হয়ে উঠবে।

শেষ মুহূর্তে, সমস্ত পদার্থ ও শক্তি একটি একক বিন্দুতে সংকুচিত হয়ে পড়বে — যাকে বলা হয় সিঙ্গুলারিটি।

এই মহাসংকোচনের নামই হলো ‘বিগ ক্রাঞ্চ’, যা কার্যত বিগ ব্যাংয়ের উল্টো রূপ।

গবেষণা অনুযায়ী, এই উল্টো যাত্রার শুরু হতে পারে আগামী ১০ বিলিয়ন বছরের মধ্যে। আর সংকোচনের এই প্রক্রিয়া শেষ হতে সময় নেবে আরও ১০ বিলিয়ন বছর। এই মডেল অনুযায়ী, মহাবিশ্বের পূর্ণ আয়ু হবে প্রায় ৩৩.৩ বিলিয়ন বছর।

আমরা ইতিমধ্যে সেই সময়সীমার ১৩.৮ বিলিয়ন বছর অতিক্রম করে ফেলেছি।

এই দাবির পেছনে কী প্রমাণ রয়েছে?

DES এবং DESI প্রকল্পের মাধ্যমে লক্ষ লক্ষ গ্যালাক্সির মানচিত্র তৈরি করা হয়েছে, যেন মহাবিশ্ব কিভাবে সময়ের সঙ্গে বিস্তৃত হচ্ছে তা মাপা যায়। এই গবেষণাগুলো আধুনিক কসমোলজির ভিত্তি হিসেবে কাজ করছে এবং মহাবিশ্বের বৃহৎ কাঠামোর সবচেয়ে বিশদ চিত্র তুলে ধরছে।

এখন পর্যন্ত পাওয়া সব পর্যবেক্ষণ বলেছিল, ডার্ক এনার্জি একটি ধ্রুবক শক্তি। কিন্তু নতুন তথ্য ইঙ্গিত দিচ্ছে, এটি সময়ের সঙ্গে পরিবর্তিতও হতে পারে।

এই ধারণা থেকেই জন্ম নিয়েছে অ্যাক্সিয়ন-ডার্ক এনার্জি মডেল বা সংক্ষেপে ‘ADE’ — একটি তাত্ত্বিক কাঠামো, যেখানে অ্যাক্সিয়ন ও পরিবর্তনশীল কসমোলজিক্যাল কনস্ট্যান্ট একসঙ্গে কাজ করে।

Space.com-এর ভাষায়, “নতুন গবেষণার সবচেয়ে চমকপ্রদ দাবি হলো — কসমোলজিক্যাল কনস্ট্যান্ট, যা ফাঁকা স্থানের শক্তির ঘনত্বকে নির্দেশ করে, সেটি হয়তো ঋণাত্মক।”

এখনো শুধুই একটি তত্ত্ব

গবেষণার লেখকরা তাদের দাবি বাড়িয়ে বলেননি। এই মডেলটি যদিও আগ্রহজনক, তবুও এটি এখনো যাচাই না হওয়া একটি তত্ত্ব।

“এই তথ্যগুলো এখনো প্রাথমিক,” গবেষকরা বলেছেন। তারা জোর দিয়েছেন, ভবিষ্যতের আরও গভীর মহাকাশ পর্যবেক্ষণ ও পরবর্তী প্রজন্মের টেলিস্কোপগুলোর সাহায্যে বোঝা যাবে সত্যিই ডার্ক এনার্জি সময়ের সঙ্গে পরিবর্তিত হয় কি না।

তবুও, এই ধারণা ইতিমধ্যেই পদার্থবিজ্ঞানীদের মধ্যে তীব্র বিতর্কের জন্ম দিয়েছে। যদি এই মডেল সত্য হয়, তাহলে আমাদের মহাবিশ্বের টাইমলাইন এবং শেষ পরিণতি নিয়ে বিজ্ঞানীদের ভাবনাগুলো পুরোপুরি বদলে যেতে পারে।

কিছু তত্ত্ব আরও একধাপ এগিয়ে যায়। তারা বলছে, বিগ ক্রাঞ্চই হয়তো চূড়ান্ত শেষ নয়।

বরং, সেই চূড়ান্ত সিঙ্গুলারিটি আবার এক নতুন ‘বিগ ব্যাং’ সৃষ্টি করতে পারে। শুরু হতে পারে একটি নতুন মহাবিশ্ব। যদিও এই ভাবনাগুলো এখনো কেবল কল্পনা পর্যায়ে রয়েছে, তবুও তারা প্রমাণ করে — বাস্তবতার প্রকৃতি সম্পর্কে আমরা এখনো কতটা অজ্ঞ।

এই মুহূর্তে নিশ্চিত বলা যায় একটাই — মহাবিশ্ব হয়তো যতটা ভাবা হয়েছিল, তার চেয়েও অনেক বেশি অপ্রত্যাশিত। বিজ্ঞানীরা যতই আকাশের গভীরে নজর ফেলছেন, উত্তরগুলো ততই চমকে দিচ্ছে।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *