Monday, July 28
Shadow

মানব মনের মালিকানা: কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার ছায়ায়

শোয়েব সাম্য সিদ্দিক, রাজশাহী, গণমাধ্যম বিশ্লেষক ও কলামিস্ট : বিজ্ঞান বদলেছে, মানুষ বদলায়নি। কিন্তু প্রযুক্তির যে ঢেউ এখন আমাদের দিকে ধেয়ে আসছে, তাতে

বদলানো শুধু বিকল্প নয়, জীবনের শর্ত হয়ে দাঁড়িয়েছে।

কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা বা এআই একটি শব্দ নয়, এটি এক মহাসমুদ্র। যার ঢেউয়ে আমরা অনেকেই

অজান্তেই ভেসে যাচ্ছি। লেখক, কবি, গীতিকার, সাংবাদিক, ডিজাইনার কিংবা নির্মাতা, যাদের

সৃষ্টিশীলতা জীবিকার উপায় ও স্বপ্নের রসদ, তারা এখন এক অনিশ্চিত ভূমিকম্পের মধ্যে দাঁড়িয়ে।

কপিরাইট বনাম কোডের জাল

একজন মানুষ যখন কবিতা লেখেন, একটি চিত্রকর্ম আঁকেন কিংবা গল্প রচনা করেন, তখন সেখানে

হৃদয়, অভিজ্ঞতা, রক্ত-মাংস ও বেদনার নির্যাস মিশে থাকে। কিন্তু এআই সেই নির্মাণগুলো

বিশ্লেষণ করে এবং চোখের পলকে তৈরি করে ফেলে হাজার হাজার অনুরূপ সৃষ্টি। অথচ সেখানে কোনো

অনুভব নেই, অভিমান নেই, শৈল্পিক দায়বদ্ধতা নেই।

কপিরাইট আইন এই পরিস্থিতিতে কার্যত নিশ্চুপ। বাংলাদেশের কপিরাইট আইন ২০০০ সালে প্রণীত

ও ২০০৫ সালে সংশোধিত হলেও তাতে জেনারেটিভ এআই শব্দটি পর্যন্ত নেই।

আমাদের সংবিধানে সৃষ্টিশীলতার মৌলিক অধিকার থাকা সত্ত্বেও সেই অধিকার আজ আঘাতপ্রাপ্ত।

কারণ এখন একজন এআইচালিত কম্পিউটার অসংখ্য কবিতার রূপরেখা বিশ্লেষণ করে ছন্দ ও

শব্দবন্ধ অনুকরণ করে এক মুহূর্তেই কবিতা নামিয়ে দেয়, যার উৎস হয়তো আপনার লেখা। অথচ

আপনি জানেন না, সেই লেখা আপনি লিখেছেন নাকি কোনো অজানা কোডের যন্ত্র।

রাজনীতি যখন এআইয়ের মালিকানা চায়

ভয়ংকর বাস্তবতা হলো, প্রযুক্তির মালিকানা মানেই তথ্যের নিয়ন্ত্রণ, আর তথ্যের নিয়ন্ত্রণ

মানেই রাজনীতির দখল। চিন্তা করুন, একটি রাজনৈতিক শক্তি যদি জনগণের মতামত, অনুভূতি ও

আবেগ বিশ্লেষণ করে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার মাধ্যমে এক ধরনের ডিজিটাল গণতন্ত্র তৈরি করে,

যেখানে মানুষের ভাবনা নিয়ন্ত্রিত, বিশ্লেষণ প্রভাবিত এবং প্রতিপক্ষের কণ্ঠস্বর ভুয়া ভিডিওয়

পরিণত হয়। তখন আপনি কি বুঝবেন এটি সত্য না সাজানো?

বাংলাদেশে ইতোমধ্যে সোশ্যাল মিডিয়ায় এআইচালিত অ্যাকাউন্ট ব্যবহার করে বিভ্রান্তিকর

ক্যাম্পেইন চালানো হচ্ছে, নকল ভিডিও দিয়ে নেতাদের চরিত্রহনন করা হচ্ছে, এমনকি সাম্প্রদায়িক

উত্তেজনাও ছড়ানো হয়েছে। এই ভয়াবহতাকে আমরা যতটুকু চিনি, বিপদ তার চেয়ে বহুগুণ গভীর।

সামাজিক শোষণ ও মধ্যবিত্তের নিঃশব্দ ক্রন্দন

যেখানে একদিকে বেকার তরুণেরা কন্টেন্ট ক্রিয়েটর হওয়ার স্বপ্ন নিয়ে এগোচ্ছে, সেখানে বড়

কর্পোরেট কোম্পানিগুলো বলছে, “তোমার দরকার নেই, আমাদের তো এআই আছে।” সৃষ্টিশীল কাজের

বাজারে যন্ত্র যখন শিল্পীর প্রতিদ্বন্দ্বী হয়ে দাঁড়ায়, তখন শিল্প শুধু কোডে বন্দী হয় না, সমাজও

হয়ে পড়ে মানবহীন।

এই প্রবণতায় সবচেয়ে বেশি বিপন্ন হয়েছে মধ্যবিত্ত শ্রেণির সম্ভাবনাগুলো। যারা না চাকরি হারাতে

চায়, না জীবনের স্বপ্ন খোয়াতে চায়, তারা এখন চুপচাপ নিজেদের নিঃশব্দে বিলিয়ে দিচ্ছে যন্ত্রের

পায়ে। রাষ্ট্র এদের খোঁজ নেয় না, আইন দেখেও না দেখে ফেরে।

বিশ্ব প্রস্তুত, বাংলাদেশ এখনো পেছনে

ইউরোপীয় ইউনিয়নের নতুন এআই অ্যাক্ট ইতোমধ্যেই কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার ব্যবহার ও অপব্যবহার

নিয়ে সুস্পষ্ট বিধান দিয়েছে। চীন, আমেরিকা, কানাডা, অস্ট্রেলিয়াসহ অন্তত ৪৩টি দেশে কপিরাইট

সংক্রান্ত এআই নীতিমালা কার্যকর রয়েছে। [সূত্র: Stanford AI Index Report 2023] সেখানে

বাংলাদেশ এখনো খসড়া পর্যায়ে, এবং অনেকেই সেটাও জানে না।

আমরা কী করব?

আমরা যদি এখনই জেগে না উঠি, তাহলে আগামী পাঁচ বছরে আমাদের সাহিত্য, গণমাধ্যম, রাজনীতি,

শিক্ষা ও সংস্কৃতি—সবই যন্ত্রচালিত হয়ে যাবে। শিল্পের ভাষা হবে অ্যালগরিদম নির্ভর, কবিতার

স্পন্দন আসবে কোডের বক্স থেকে, আর মতপ্রকাশের স্বাধীনতা পরিণত হবে প্রোগ্রামড

পারমিশনে। আমরা কি চাই, আমাদের সন্তানদের এমন এক পৃথিবীতে বড় হতে যেখানে মানুষ লিখবে না,

কেবল সফটওয়্যার লিখবে?

এক গবেষণায় দেখা গেছে, ২০২৭ সালের মধ্যে পৃথিবীর ৪০ শতাংশ ক্রিয়েটিভ কনটেন্ট এআই দ্বারা

উৎপন্ন হবে, যার ৭৫ শতাংশ মানুষ টেরও পাবে না এটি মানুষের লেখা কিনা। এই প্রবণতা থামাতে না

পারলে বাংলাদেশের মতো উন্নয়নশীল দেশগুলোর সৃজনশীল কর্মসংস্থান ও অর্থনীতির বড় ক্ষতি

হবে।

এআই এখন শুধু কনটেন্ট তৈরি করছে না, চিন্তার নকশাও তৈরি করছে। রাজনৈতিক প্রচারণা,

নির্বাচনী কৌশল, জনমত প্রভাব, এমনকি সামাজিক সেন্সরশিপও এআইয়ের মাধ্যমে দ্রুত ছড়িয়ে

পড়ছে। যেমন, ২০২৪ সালের আমেরিকান নির্বাচনে ডিপফেইক অডিও দিয়ে গুজব ছড়ানো হয়েছে।

আমরা যদি এখনই ব্যবস্থা না নিই, আইন না করি, সচেতনতা না বাড়াই, জবাবদিহিতার কাঠামো না

গড়ি, তাহলে আগামী প্রজন্ম এমন এক জগতে বড় হবে যেখানে মস্তিষ্ক থাকবে কিন্তু মন থাকবে না,

ভাষা থাকবে কিন্তু প্রাণ থাকবে না, সিদ্ধান্ত থাকবে কিন্তু দায় থাকবে না।

তাই প্রযুক্তির ব্যবহার শেখার পাশাপাশি তার নৈতিকতা, সীমা ও জবাবদিহি নিশ্চিত করাও জরুরি।

আমাদের সমাজ, রাষ্ট্র ও তরুণদের প্রস্তুত করতে হবে এই বাস্তবতার জন্য। নইলে মানবিকতা

নামক ঐতিহ্য একদিন শুধু পাঠ্যবইয়ের অধ্যায় হয়ে থাকবে।

আমাদের দরকার

কপিরাইট আইন যুগোপযোগী করা, যেখানে এআই উৎপাদিত কনটেন্ট আলাদা করে চিহ্নিত করতে

বাধ্য করা হবে

সৃষ্টিশীল পেশাজীবীদের জন্য ডিজিটাল কপিরাইট বোর্ড গঠন

ডিপফেইক ও কৃত্রিম কনটেন্ট শনাক্ত ও নিয়ন্ত্রণে তথ্যপ্রযুক্তি আইন ও সাইবার সেলের যৌথ

তদারকি

গণমাধ্যম ও শিক্ষাক্ষেত্রে এআই সচেতনতা বাধ্যতামূলক করা

রাজনৈতিক স্বার্থে এআই অপব্যবহার ঠেকাতে নির্বাচন কমিশনের আওতায় প্রযুক্তি নিরীক্ষা

ইউনিট গঠন

উপসংহার

আমরা এখন এমন এক সন্ধিক্ষণে দাঁড়িয়ে আছি, যেখানে আমাদের সিদ্ধান্ত আগামী প্রজন্মের

পরিচয় নির্ধারণ করবে। আমরা কি একটি দায়িত্বশীল, নীতিনিষ্ঠ ও সৃজনশীল সমাজ গড়ব, নাকি সহজ

প্রযুক্তির মোহে পড়ে মানবিক সত্তা হারিয়ে ফেলব?

সৃষ্টিশীলতাকে যদি কেবল কোড আর অ্যালগরিদমে বন্দী করি, তাহলে আগামী দিনের কবিরা কি আর

কবি থাকবে? পাঠকের হৃদয় না ছুঁয়ে কেবল নিখুঁত গঠনে তৈরি লেখাই কি হবে ভবিষ্যতের সাহিত্য?

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *