Sunday, July 27
Shadow

উপর মহলের উত্তেজনা বনাম তৃণমূলের আর্তনাদ: গণতন্ত্রের সম্ভাবনা ও রাষ্ট্রীয় পুনর্বিন্যাসের সন্ধিক্ষণ

মোঃ রাফিউজ্জামান রাফি, সরকারি কবি নজরুল কলেজ, ঢাকা:

আজকের বাংলাদেশ একটি দ্বিমুখী বাস্তবতার মুখোমুখি—একদিকে রয়েছে ক্ষমতার কেন্দ্রস্থলে নানামুখী উত্তেজনা, বৈশ্বিক রাজনীতির প্রভাব এবং রাষ্ট্রীয় কাঠামোর দৃঢ় নিয়ন্ত্রণ; অন্যদিকে রয়েছে তৃণমূল জনগণের নীরব দীর্ঘশ্বাস, সামাজিক নিরাপত্তাহীনতা ও অংশগ্রহণহীনতার গভীর বেদনা।

এই বাস্তবতার গভীরে প্রশ্ন জাগে—আমরা কি কেবল একটি ‘নির্বাচন’ করেই গণতন্ত্র নিশ্চিত করেছি, নাকি গণতন্ত্র কেবল একটি শব্দ হয়ে উঠেছে যার বাস্তব প্রতিচ্ছবি দিন দিন ম্লান হয়ে যাচ্ছে?

ভূরাজনীতি: বন্ধুত্বের চেয়ে অবস্থান এখন বেশি গুরুত্বপূর্ণ

বাংলাদেশ এখন আর কোনো বিচ্ছিন্ন ভূখণ্ড নয়; বরং একটি গুরুত্বপূর্ণ কৌশলগত অবস্থানে রয়েছে। পাশ্ববর্তী ও দূরবর্তী পরাশক্তিগুলো এখানে তাদের স্বার্থের জায়গা তৈরি করতে চায়—কেউ মানবাধিকার ও গণতন্ত্রের নামে, কেউ বাণিজ্য ও নিরাপত্তার অজুহাতে, আবার কেউ চুপচাপ স্থিতিশীলতার মোড়কে প্রভাব ধরে রাখতে চায়।

এ অবস্থায় একটি স্বাধীন রাষ্ট্রের কূটনৈতিক চ্যালেঞ্জ হলো—নিজস্ব স্বার্থ রক্ষা করে আন্তর্জাতিক ভারসাম্য বজায় রাখা। কিন্তু বাস্তবে দেখা যাচ্ছে, অনেক ক্ষেত্রেই অভ্যন্তরীণ রাজনীতির অনিশ্চয়তা আমাদের পররাষ্ট্রনীতিকেও ধোঁয়াশাপূর্ণ করে তুলেছে।

রাজনৈতিক কাঠামো ও নির্বাচন: আনুষ্ঠানিকতা বনাম অংশগ্রহণ

নির্বাচন একটি রাষ্ট্রের গণতান্ত্রিক পথচলার অন্যতম মাধ্যম। তবে গণতন্ত্র তখনই কার্যকর হয়, যখন নির্বাচন হয় অংশগ্রহণমূলক, প্রতিযোগিতামূলক এবং গ্রহণযোগ্য। বর্তমান সময়ে নির্বাচনকে কেন্দ্র করে যে প্রশ্নগুলো উঠছে—তা কেবল কারা জিতলো বা হারলো তাই নয়, বরং প্রশ্ন হচ্ছে কী হারালো রাষ্ট্র, কী হারালো নাগরিক?

অনেক সময় দেখা যায়—নির্বাচনের প্রস্তুতি, পরিবেশ এবং ফলাফল নিয়ে জনগণের আস্থা কমে গেলে গণতন্ত্রের মূল ভিত্তিই নড়বড়ে হয়ে পড়ে। এমন বাস্তবতায় কেবল সংবিধানের ধারায় নির্বাচন আয়োজন করলেই রাষ্ট্রীয় কর্তব্য শেষ হয় না; জনগণের অন্তর্ভুক্তি ও অংশগ্রহণ নিশ্চিত করাই সবচেয়ে বড় কর্তব্য।

তৃণমূলের প্রতিচিত্র: উন্নয়ন এবং অদৃশ্য বঞ্চনা

বিগত এক দশকে দেশের অবকাঠামোগত উন্নয়ন দৃশ্যমান। সেতু, সড়ক, বিদ্যুৎ, প্রযুক্তি—এসব উন্নয়নের গতি প্রশংসনীয়। তবে প্রশ্ন উঠছে—এই উন্নয়নের সুফল কি সুষমভাবে জনগণের কাছে পৌঁছেছে?

তৃণমূল পর্যায়ে মানুষের মৌলিক চাহিদা পূরণে এখনও অনেক ঘাটতি রয়েছে। স্বাস্থ্যসেবা, শিক্ষার মান, কর্মসংস্থান, দ্রব্যমূল্য ইত্যাদি বিষয়ে জনগণের হতাশা বাড়ছে। অবকাঠামো যতই উন্নত হোক না কেন, যদি মানুষের জীবনযাত্রার মান না বাড়ে, তবে সেই উন্নয়ন স্থায়ী শান্তি ও সামাজিক স্থিতি আনতে পারে না।

গণতন্ত্রের চর্চা: কণ্ঠস্বর থাকলেই মতপ্রকাশ হয় না

একটি গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র কেবল একটি নির্বাচন দিয়ে টিকে থাকে না। এতে প্রয়োজন হয় মতপ্রকাশের স্বাধীনতা, শক্তিশালী নাগরিক সমাজ, কার্যকর বিরোধী কণ্ঠ, জবাবদিহিতামূলক প্রশাসন এবং ন্যায়বিচারপূর্ণ রাষ্ট্রব্যবস্থা।

বর্তমানে মতপ্রকাশের স্বাধীনতা, গণমাধ্যমের ভূমিকা এবং নাগরিক সমাজের অংশগ্রহণ নিয়েও প্রশ্ন উঠছে। নীতিনির্ধারক পর্যায়ে জনসাধারণের কণ্ঠ কতটা প্রতিফলিত হয়, সেটিই গণতন্ত্রের প্রকৃত সূচক।

সম্ভাবনার দিগন্ত: কিছু প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ

বিশেষজ্ঞ ও সমাজবিজ্ঞানীদের মতে, বর্তমান বাস্তবতায় বাংলাদেশের গণতান্ত্রিক ও রাষ্ট্রীয় কাঠামোকে আরও দৃঢ় ও অন্তর্ভুক্তিমূলক করতে নিচের বিষয়গুলো বিবেচনায় নেওয়া যেতে পারে:

১. অন্তর্ভুক্তিমূলক সংলাপ:

রাজনীতির সব পক্ষের মধ্যে একটি দীর্ঘমেয়াদি ঐক্যমত্য তৈরি করা—যেখানে নির্বাচনী কাঠামো, প্রশাসনিক নিরপেক্ষতা ও জনগণের অংশগ্রহণ নিয়ে বাস্তবভিত্তিক আলোচনা হবে।

২. শক্তিশালী ও স্বাধীন নির্বাচন কমিশন:

প্রশাসন, আইনশৃঙ্খলা ও নীতিনির্ধারণে নির্বাচন কমিশনের ক্ষমতা বৃদ্ধি করে নিরপেক্ষতা নিশ্চিত করতে হবে।

৩. স্থানীয় সরকারে ক্ষমতা বিকেন্দ্রীকরণ:

কেন্দ্রীয় রাজনীতি যদি তৃণমূলকে প্রভাবিত করে, তবে উন্নয়নও কেন্দ্রীভূত হয়। স্থানীয় সরকারের ক্ষমতা ও বাজেট বৃদ্ধি করলেই প্রকৃত গণতন্ত্রের শিকড় গড়বে।

৪. শিক্ষিত, সচেতন ও অংশগ্রহণমূলক নাগরিকতা:

নাগরিকদের মধ্যে রাজনৈতিক সচেতনতা ও অধিকার সম্পর্কে জ্ঞান বৃদ্ধি করতে হবে। একটি সচেতন জনগোষ্ঠীই পারে রাজনীতিকে দায়িত্বশীল রাখতে।

৫. পররাষ্ট্রনীতিতে ভারসাম্য ও আত্মমর্যাদা:

ভূরাজনৈতিক খেলায় অংশ না নিয়ে, প্রতিটি কূটনৈতিক সিদ্ধান্তে দেশের সার্বভৌমত্ব ও স্বার্থকে প্রাধান্য দিতে হবে।

সময় এখন দায়বদ্ধতার, প্রতিহিংসার নয়

একটি রাষ্ট্র যখন কেবল জয়ের মানসিকতায় পরিচালিত হয়, তখন হেরে যায় মানুষের অধিকার। আজকের সংকট কেবল কোনো দলীয় দ্বন্দ্ব নয়; এটি একটি রাষ্ট্র, একটি জাতি ও একটি স্বপ্নের প্রশ্ন।

উপর মহলের উত্তেজনা যদি তৃণমূলের আর্তনাদ না শুনে, তবে ভবিষ্যতের ইতিহাস তা নির্দয় ভাষায় লিখে রাখে। এখনো সময় আছে—সকল পক্ষ, সকল মানুষ, সকল প্রতিষ্ঠানকে নিয়ে গণতান্ত্রিক ঐক্য ও অন্তর্ভুক্তিমূলক উন্নয়নের পথে ফিরে যাওয়া। তবেই জাতি এগোবে, তবেই গণতন্ত্র প্রাতিষ্ঠানিক রূপ পাবে।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *