Sunday, July 27
Shadow

আকাশপথের শোকগাথা: মাইলস্টোনের ট্রাজেডি ও রাষ্ট্রের দায়

শোয়েব সাম্য সিদ্দিক, গণমাধ্যম বিশ্লেষক, সিনিয়র প্রিন্সিপাল অফিসার সোনালী ব্যাংক পিএলসি, রাজশাহী : ঢাকার উত্তরা। স্কুল শেষে প্রাণোচ্ছল শিশুরা যখন ঘরে ফেরার প্রস্তুতিতে ব্যস্ত, ঠিক সেই মুহূর্তে

আকাশ ভেদ করে নেমে এলো মৃত্যু। বাংলাদেশ বিমান বাহিনীর চীনা তৈরি এফটি ৭ বিজিআই মডেলের

একটি যুদ্ধবিমান বিকট শব্দে সজোরে আছড়ে পড়ল মাইলস্টোন স্কুল অ্যান্ড কলেজ ভবনের ওপর।

মুহূর্তেই জ্বলন্ত ধ্বংসস্তূপে পরিণত হলো ছেলেমেয়েদের প্রাণভরা শ্রেণিকক্ষ। নিভে গেল ৩১টি

কোমল প্রাণ, আহত হলো আরও শতাধিক। এমন হৃদয়বিদারক দৃশ্য মর্মাহত করেছে পুরো জাতিকে। এই

মর্মান্তিক ঘটনার পর মানুষ কাঁদছে, ক্ষুব্ধ হচ্ছে এবং একই সঙ্গে ভাবছে — এত বড় দুর্ঘটনা কি

কেবলই দুর্ঘটনা, নাকি আমাদের দীর্ঘদিনের অব্যবস্থাপনার পরিণতি?

দুর্ঘটনার ধারাবাহিকতা এবং বাস্তবতা

বাংলাদেশে প্রশিক্ষণ বিমান দুর্ঘটনা নতুন নয়। গত কয়েক দশকে দেশের আকাশপথে ছড়িয়ে আছে

অসংখ্য ধ্বংসস্তূপ আর অকালমৃত পাইলটদের কাহিনি। যশোর, বগুড়া, চট্টগ্রাম, কুমিল্লা ও ঢাকার

আকাশ যেন অদৃশ্য শোকস্তম্ভ হয়ে দাঁড়িয়ে আছে। বাংলাদেশ বিমান বাহিনীর নথি অনুযায়ী, গত ৩৪

বছরে অন্তত ৩২টি বিমান দুর্ঘটনা ঘটেছে, যার মধ্যে অন্তত ২৫টি ঘটেছে প্রশিক্ষণ চলাকালে। শুধু

গত ১২ বছরেই অন্তত ৭ জন পাইলট প্রাণ হারিয়েছেন। প্রতিবার দুর্ঘটনার পর একটি তদন্ত কমিটি

গঠিত হয়, প্রাথমিক কিছু সুপারিশ আসে, শোক প্রকাশ করা হয়, তারপর সবকিছু ধীরে ধীরে আড়ালে

চলে যায়। কিন্তু আকাশপথে মৃত্যুর মিছিল যেন থামছে না বরং বেড়েই চলেছে।

‘ফ্লাইং কফিন’ হয়ে ওঠা বহর

বাংলাদেশ বিমান বাহিনীর বহরে এখনো ভরসা করতে হয় সত্তর ও আশির দশকের নকশায় তৈরি এফ ৭

সিরিজের যুদ্ধবিমানের ওপর। এই মডেলের উৎপাদন ২০১৩ সালেই বন্ধ হয়ে গেছে। অথচ আমাদের

বহরে এখনও অন্তত ৩৬টি যুদ্ধবিমান এই সিরিজের। বাকি কিছু মিগ ২৯ এবং চীন থেকে আনা বেশ

কয়েকটি জঙ্গিবিমানও কার্যকারিতা হারিয়ে ফেলেছে। আন্তর্জাতিকভাবে এই ধরনের বিমানের

অনেকগুলোকে বলা হয় ‘ফ্লাইং কফিন’ — অর্থাৎ আকাশে উড়লেই মৃত্যুর ঝুঁকি বহন করছে। একটি

যুদ্ধবিমানের নির্ধারিত উড্ডয়ন ঘণ্টা থাকে। একবার সেই সীমা পেরিয়ে গেলে ধাতব কাঠামো এবং

ইঞ্জিনে চূড়ান্ত পরিশ্রমের ছাপ পড়ে যা হঠাৎ ভেঙে পড়তে পারে। আমাদের যেসব বিমান এখনো

উড়ছে তাদের অনেকগুলোই কার্যত বিপজ্জনক হয়ে উঠেছে। অথচ এই বিপদ মাথায় রেখেও বহর

আধুনিকায়নের কাজ এখনো ধীরগতির।

জনবসতিতে উড্ডয়ন আর কৌশলগত অদূরদর্শিতা

বিশ্বের অনেক দেশেই সামরিক বিমানঘাঁটি ও প্রশিক্ষণ জোন নির্ধারণ করা হয় জনমানবহীন

এলাকায়। কারণ প্রশিক্ষণকালে পাইলটরা যান্ত্রিক ত্রুটি বা হঠাৎ কোনো ক্রান্তিকালে পুরো

নিয়ন্ত্রণ রাখতে না পারলে বিমান নিচে পড়তে বাধ্য। সেই দুর্ঘটনায় যেন সাধারণ মানুষের প্রাণহানি

না ঘটে তা নিশ্চিত করা হয় পরিকল্পনার সময়েই। অথচ বাংলাদেশে ঠিক উল্টো চিত্র। ঢাকার মতো

ঘনবসতিপূর্ণ নগরীর আকাশপথে প্রতিদিন উড়ছে সামরিক জঙ্গিবিমান। উড্ডয়ন ও অবতরণের সময়ই

যেহেতু দুর্ঘটনার সম্ভাবনা বেশি সেহেতু প্রাণহানির আশঙ্কাও অনেক গুণ বেশি। সামরিক ঘাঁটি

স্থানান্তর এবং প্রশিক্ষণ এলাকা জনমানবহীন জেলায় সরানোর উদ্যোগ বহুবার আলোচিত হলেও

কখনোই বাস্তবায়ন হয়নি। মাইলস্টোন স্কুলের ৩১টি শিশুর মৃত্যু যেন সেই অদূরদর্শিতার করুণ

ফলাফল।

বাজেটের অসঙ্গতি আর থার্ড টার্মিনালের অজানা ব্যয়

সাম্প্রতিক বছরগুলোয় বাংলাদেশের সামরিক বাজেট বেড়েছে ঠিকই। কিন্তু যুদ্ধবিমান আধুনিকায়ন

এবং প্রশিক্ষণ প্রযুক্তি হালনাগাদের জন্য বরাদ্দ কমেছে। ২০১৮ থেকে ২০২২ সালের মধ্যে অস্ত্র

আমদানি কমেছে প্রায় ৪৮ শতাংশ। এই সময়ে বিপুল ব্যয়ে রাজধানীর শাহজালাল আন্তর্জাতিক

বিমানবন্দরে নির্মাণ করা হয়েছে বহুল আলোচিত থার্ড টার্মিনাল। প্রকল্পটি এখনো পূর্ণাঙ্গভাবে

চালু হয়নি। অথচ সরকারের ভাষায় বলা হয়েছিল এতে দেশের আকাশপথের সক্ষমতা ও নিরাপত্তা

অনেক বেড়ে যাবে। এখন প্রশ্ন উঠছে — এই বিশাল ব্যয় আসলে আকাশপথকে কতটা নিরাপদ করেছে?

যদি দুর্ঘটনার মিছিল না থামে তবে এই অঢেল ব্যয় কাদের স্বার্থ রক্ষা করছে? মাইলস্টোনের

শিশুদের প্রশ্নের উত্তর রাষ্ট্রকে দিতে হবে।

বিভ্রান্তি না ছড়িয়ে দায়িত্বশীলতা দেখানো জরুরি

প্রশিক্ষণ বিমান দুর্ঘটনার পরপরই সামাজিক মাধ্যমে নানা বিভ্রান্তিকর তথ্য ছড়িয়ে পড়ে।

অনেকেই অনুমানভিত্তিক তথ্য দেন যা জাতীয় নিরাপত্তা এবং বিমান বাহিনীর ভাবমূর্তিকে আঘাত

করে। অথচ বাস্তবতা হলো পাইলটরা শেষ মুহূর্ত পর্যন্ত প্রাণপণ চেষ্টা করেন বিমান জনবসতিমুক্ত

স্থানে নামানোর। অনেক সময় যান্ত্রিক ব্যর্থতা এত দ্রুত ঘটে যে পাইলটের করার কিছু থাকে না।

জনগণ ও গণমাধ্যমের দায়িত্ব সঠিক তথ্য না পাওয়া পর্যন্ত গুজব না ছড়ানো। দুর্ঘটনায় নিহত

পাইলটদের বীরত্বকেও যথাযথ সম্মান জানাতে হবে।

এখনই যা করা জরুরি: করণীয় সুপারিশসমূহ

১️⃣ রাজধানীর বাইরে নতুন আন্তর্জাতিক মানের বিমানবন্দর তৈরি করুন।

২️⃣ পঞ্চম প্রজন্মের যুদ্ধবিমান সংগ্রহ করুন।

৩️⃣ প্রশিক্ষণ ঘাঁটি ও উড্ডয়ন জোন পুনর্বিন্যাস করুন।

৪️⃣ রক্ষণাবেক্ষণ ও মান নিয়ন্ত্রণে কড়া নজর দিন।

৫️⃣ ফ্লাইট সিমুলেটর ট্রেনিং আরও জোরদার করুন।

৬️⃣ জনমানুষের সুরক্ষা নীতি প্রণয়ন করুন।

৭️⃣ জনসচেতনতা ও তথ্যশৃঙ্খলা নিশ্চিত করুন।

আত্মত্যাগের প্রেরণা

মাইলস্টোন স্কুলের শিক্ষিকা মেহেরীন চৌধুরী নিজের জীবন দিয়ে অন্তত ২০টি শিশুকে বাঁচিয়েছিলেন।

এই আত্মত্যাগ আমাদের বোঝাতে পারে — নিরাপত্তা কোনো বিলাসিতা নয়, এটি রাষ্ট্রের ন্যূনতম

দায়িত্ব। এমন আরেকটি মেহেরীন যেন আমাদের হারাতে না হয়। প্রতিটি শিশুর প্রাণ যেন রাষ্ট্রের

কাছে অমূল্য হয়ে ওঠে।

শেষ কথা

কেবল শোক প্রকাশ করে দায়িত্ব শেষ করা যাবে না। আকাশপথ আরেকটি শিশুর রক্তে রঞ্জিত

হওয়ার আগে এখনই সিদ্ধান্ত নিতে হবে। অকার্যকর নীতি ও অদূরদর্শী পরিকল্পনার আড়ালে লুকিয়ে

থাকলে প্রতিটি উড্ডয়নই একেকটি শোকবার্তা হয়ে উঠবে। আকাশের নিরাপত্তা নিশ্চিত করা রাষ্ট্র

ও সমাজের সম্মিলিত দায়িত্ব। এখনই সময় নতুন করে ভাবার নতুন করে পদক্ষেপ নেওয়ার।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *