
বাংলাদেশের ব্যাংক খাত চরম সংকটে পড়েছে। খেলাপি ঋণের লাগামহীন বৃদ্ধি, মূলধন ঘাটতি এবং রাজনৈতিক প্রভাবের কারণে ধসে পড়ছে এই খাতের ভিত। বাংলাদেশ ব্যাংকের সর্বশেষ তথ্য বলছে, ২০২৫ সালের শুরুতে ব্যাংক খাতে খেলাপি ঋণের পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ৩ লাখ ৪৫ হাজার ৭৬৫ কোটি টাকা—যা এক বছর আগের তুলনায় প্রায় ২ লাখ কোটি টাকা বেশি।
খেলাপি ঋণের সবচেয়ে বড় অংশ এসেছে বড় অঙ্কের ঋণ থেকে। ১০০ কোটির বেশি পরিমাণের ঋণ থেকে খেলাপি হয়েছে ৫৭ শতাংশ, যার পরিমাণ ১ লাখ ৬৪ হাজার কোটি টাকা। মাত্র ১০টি বড় ব্যবসায়ী গ্রুপের খেলাপি ঋণই ৫৪ হাজার কোটি টাকা ছাড়িয়েছে।
বিশ্লেষকরা বলছেন, রাজনৈতিক ছত্রছায়ায় কিছু প্রভাবশালী গ্রুপ ঋণ পরিশোধ না করেও পুনঃতফসিল, সুদ মওকুফ ও পুনর্গঠনের সুবিধা পেয়েছে। অর্থনীতিবিদ ড. মোস্তফা কে মুজেরী বলেন, “ব্যাংকগুলো সরকারের ইচ্ছানুযায়ী চলে, যা ব্যাংক ব্যবস্থাকে দুর্বল করে দিয়েছে।”
এক সময় নিয়মিত ঋণ পরিশোধকারী হিসেবে পরিচিত বেক্সিমকো ও এস আলম গ্রুপও এখন কেন্দ্রীয় ব্যাংকের খেলাপি তালিকায়। বেক্সিমকোর খেলাপি ঋণ প্রায় ১০ হাজার কোটি, আর এস আলমের প্রায় ৯ হাজার কোটি টাকা।
বিশ্লেষকরা বলছেন, শুধু পরিমাণ নয়—কীভাবে ঋণগুলো খেলাপি হলো, তা জনসমক্ষে আনা জরুরি। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের এক গোপন প্রতিবেদনে দেখা যায়, শীর্ষ ২০ খেলাপির কাছেই রয়েছে মোট খেলাপি ঋণের ৩৫ শতাংশ।
২০২৪ সালের শেষে ২০টি ব্যাংকের সম্মিলিত মূলধন ঘাটতি দাঁড়িয়েছে ১ লাখ ৭১ হাজার ৭৮৯ কোটি টাকা, যা তিন মাস আগেও ছিল ৫৩ হাজার ২৫৩ কোটি। এক বছরে সামগ্রিক মূলধন ঘাটতি বেড়ে দাঁড়িয়েছে ১ লাখ ১৭ হাজার ৬৪৭ কোটি টাকা।
জনতা, কৃষি, ইউনিয়ন, ফার্স্ট সিকিউরিটি, ইসলামী, সোশ্যাল ইসলামী ও আইএফআইসি ব্যাংক সবচেয়ে বেশি মূলধন ঘাটতির মুখে রয়েছে। এর মধ্যে জনতা ব্যাংকের ঘাটতি ৫২ হাজার কোটির বেশি।
ব্যাংকগুলোর মূলধনের বিপরীতে ঝুঁকির অনুপাত (সিআরএআর) নেমে এসেছে মাত্র ৩.০৮ শতাংশে, যেখানে আন্তর্জাতিক মানদণ্ড ব্যাসেল-৩ অনুসারে এটি কমপক্ষে ১০ শতাংশ হওয়া উচিত।
মূলধন ঘাটতির কারণে ব্যাংকগুলোর মধ্যে অনেকেই এখন লভ্যাংশ দিতে পারছে না, এলসি খোলা ও আন্তর্জাতিক লেনদেনেও জটিলতা সৃষ্টি হয়েছে। এতে করে গ্রাহক ও বিদেশি বিনিয়োগকারীদের আস্থা হারাচ্ছে ব্যাংক খাত।
আইন বিশেষজ্ঞদের মতে, খেলাপি আদায়ে আইন থাকলেও তা কার্যকরভাবে প্রয়োগ হয় না। দীর্ঘসূত্রতা, রাজনৈতিক হস্তক্ষেপ এবং কেন্দ্রীয় ব্যাংকের গোপনীয়তা পরিস্থিতিকে আরও জটিল করে তুলেছে।
বিশ্লেষকরা বলছেন, এই সংকট থেকে উত্তরণে জরুরি কিছু পদক্ষেপ নিতে হবে।
এগুলো হলো:
- খেলাপি ঋণ আদায়ে কঠোর আইন প্রয়োগ
- রাজনৈতিক বিবেচনায় ছাড়-তফসিল বন্ধ
- খেলাপিদের তালিকা জনসমক্ষে প্রকাশ
- বাংলাদেশ ব্যাংকের স্বাধীনতা নিশ্চিত
- ঋণ সংক্রান্ত মামলার দ্রুত নিষ্পত্তিতে বিশেষ ট্রাইব্যুনাল
- ব্যাংক ব্যবস্থায় স্বচ্ছতা ও জবাবদিহি
- গ্রাহক আস্থা ও আন্তর্জাতিক সম্পর্ক পুনরুদ্ধারে দ্রুত পুনর্গঠন
অগ্রণী ব্যাংকের চেয়ারম্যান সৈয়দ আবু নাসের বখতিয়ার আহমেদ বলেন, “গত ১৫ বছরে ব্যাংক খাতে ভয়াবহ রাজনৈতিক প্রভাব ও লুটপাট হয়েছে। এখন প্রায় ৫০ শতাংশ ব্যাংকের অবস্থা বিপজ্জনক।”