
চার বছর আগে শ্রীলঙ্কার উপকূলে ‘এক্স-প্রেস পার্ল’ নামের একটি কার্গো জাহাজে ভয়াবহ অগ্নিকাণ্ড ও ডুবির ঘটনায় পৃথিবীর ইতিহাসে সবচেয়ে বড় প্লাস্টিক ছড়িয়ে পড়ার ঘটনা ঘটে। সেই বিপর্যয়ের বিষাক্ত ছায়া এখনো রয়ে গেছে দেশটির সমুদ্রসীমা ও উপকূলজুড়ে।
আজও স্বেচ্ছাসেবীরা শ্রীলঙ্কার উপকূল থেকে কিলো কিলো ছোট ছোট প্লাস্টিক দানা – যেগুলোকে বলা হয় ‘নারডল’ – বালু ছেঁকে তুলে আনছেন। ধারণা করা হয়, ২০২১ সালে ডুবে যাওয়া এই জাহাজ থেকে কোটি কোটি নারডল ছাড়াও টন টন ইঞ্জিন তেল, অ্যাসিড, কস্টিক সোডা, সীসা, তামার ধাতব বর্জ্য, লিথিয়াম ব্যাটারি ও ইপক্সি রেজিন ছড়িয়ে পড়ে — যা সবই সামুদ্রিক প্রাণীর জন্য মারাত্মক বিষাক্ত।
“বরফের মতো নারডল, আর মৃত কচ্ছপ–ডলফিনের সারি”
দুর্ঘটনার প্রথম দিকেই উপকূলীয় অঞ্চল সাদা হয়ে যায় নারডলে। সঙ্গে ভেসে উঠতে থাকে মৃত কচ্ছপ, ডলফিন আর মাছ। পরিবেশবাদী সংগঠন “পার্ল প্রোটেক্টরস”-এর প্রতিষ্ঠাতা মুদিথা কাতুভাওয়ালার ভাষায়, “দৃশ্যটা ছিল যেন যুদ্ধের সিনেমা থেকে উঠে আসা।”
তিনি বলেন, “আমরা কচ্ছপের দেহে পুড়েছে এমন চিহ্ন দেখেছি, ত্বক খসে পড়ছে, চোখ-নাক ফোলা লাল হয়ে গেছে। ডলফিনগুলোর অবস্থাও একই। এমন ভয়াবহ দৃশ্য ছিল নারডলের বরফে ঢাকা উপকূলে।”
প্রথম দিকে তারা প্রতিদিন প্রায় ৩০০ থেকে ৪০০ কেজি নারডল সংগ্রহ করতেন, যা সময়ের সঙ্গে কমে গিয়ে কয়েক কেজিতে নেমে আসে। কারণ নারডল বালুর গভীরে ঢুকে যায় এবং খুঁজে পাওয়া কঠিন হয়ে পড়ে।
প্লাস্টিক আরও বিষাক্ত হয়ে উঠছে
বিবিসি ও ওয়াটারশেড ইনভেস্টিগেশনসের সহযোগিতায় ম্যানচেস্টার মেট্রোপলিটন ইউনিভার্সিটির ফরেনসিক কেমিস্টরা নারডলের নমুনা বিশ্লেষণ করে জানান, আগুনে পোড়া নারডলগুলোর মধ্যে রয়েছে বিষাক্ত ধাতু যেমন আর্সেনিক, সীসা, ক্যাডমিয়াম, তামা, কোবাল্ট ও নিকেল।
বিশেষজ্ঞ ডেভিড মেগসন জানান, “এই নারডলগুলো যেন একেকটা রাসায়নিক স্পঞ্জ। সময়ের সঙ্গে সঙ্গে সমুদ্র থেকে আরও দূষণ শুষে নিচ্ছে।” এই দূষিত নারডলগুলো মাছ খেয়ে ফেললে তা মানবদেহেও বিষ ছড়াতে পারে।
জাহাজডুবির এলাকা ও আশপাশের লেগুন থেকে ধরা মাছেও মিলেছে একইসব বিষাক্ত ধাতুর উপস্থিতি। কিছু মাছের দেহে এসব উপাদানের পরিমাণ নিরাপদ মাত্রার চেয়েও বেশি।
চিরস্থায়ী ক্ষতি, ন্যায্য ক্ষতিপূরণ নিয়ে দ্বন্দ্ব
জাহাজটির মালিক প্রতিষ্ঠান এক্স-প্রেস ফিডারস জানিয়েছে, তারা এখন পর্যন্ত ১৩০ মিলিয়ন ডলার ব্যয় করেছে জাহাজের ধ্বংসাবশেষ ও সমুদ্রের আবর্জনা সরাতে, এবং ২০ মিলিয়ন ডলার দিয়েছে শ্রীলঙ্কা সরকারকে উপকূল পরিষ্কার ও জেলেদের ক্ষতিপূরণ দিতে।
তবে শ্রীলঙ্কা সরকার বলছে, আদালতের আদেশে মালিকপক্ষ যে পরিমাণ অর্থ দিয়েছে, তা দীর্ঘমেয়াদি ক্ষতির তুলনায় অপ্রতুল। তারা ক্ষতিপূরণের সীমা তুলে দেওয়ার জন্য আইনি লড়াই চালিয়ে যাচ্ছে।
সম্প্রতি শ্রীলঙ্কার সুপ্রিম কোর্ট জাহাজ মালিকপক্ষকে ১ বিলিয়ন ডলার প্রদানের নির্দেশ দিয়েছে, যা একটি প্রাথমিক ক্ষতিপূরণ বলে উল্লেখ করা হয়েছে। যদিও আদালতের এখতিয়ার সিঙ্গাপুরভিত্তিক এক্স-প্রেস ফিডারসের ওপর নেই।
৬ বিলিয়ন ডলারের ক্ষয়ক্ষতির হিসাব
শ্রী জয়াবর্ধনপুরা বিশ্ববিদ্যালয়ের পরিবেশ অর্থনীতিবিদ অধ্যাপক প্রশান্তি গুনারত্নে বলেন, এই দুর্ঘটনার প্রকৃত ক্ষতির পরিমাণ ৬ বিলিয়ন ডলারের বেশি। এতে রয়েছে বন্যপ্রাণী, পর্যটন ও মৎস্যজীবীদের ক্ষতি এবং বিষাক্ত ধোঁয়ার প্রভাবে জনস্বাস্থ্যের ঝুঁকি। তাঁর দাবি, “এই ঘটনায় মুক্ত হওয়া বিষাক্ত ডাইঅক্সিন ও ফুরান বাতাসে ছড়িয়ে পড়েছে, যা ক্যানসারের কারণ। আমাদের হিসাব মতে এতে দেশে প্রায় ৭০ জন মানুষ মারা যেতে পারে।”
এই মূল্যায়নকে ‘অবৈজ্ঞানিক’ ও ‘অবিশ্বস্ত’ বলে প্রত্যাখ্যান করেছে এক্স-প্রেস ফিডারস। তারা দাবি করেছে, জাহাজের ক্রু আন্তর্জাতিক নিয়ম মেনেই অ্যাসিড লিকের বিষয়টি মোকাবিলা করেছিল।
“আমরা মাছ পাচ্ছি না, ছেলেও দেশ ছাড়তে চায়“
স্থানীয় জেলে জুডে সুলান্তা জানান, “জাহাজডুবির পর থেকে আমরা আগের মতো মাছ পাচ্ছি না। উপকূলজুড়ে নতুন মাছ দেখা যায় না। আমাদের জীবন এলোমেলো হয়ে গেছে।”
তিনি বলেন, “অনেকেই নৌকা বিক্রি করে বিদেশে চলে যেতে চাইছে। আমার ছেলেও এখন আমার সঙ্গে মাছ ধরছে, কিন্তু সেও ভাবছে দেশ ছাড়ার কথা। এত বছর কেটে গেছে। যদি ন্যায্য বিচার পেতাম, এত দিনে পেতাম।”
শ্রীলঙ্কার জন্য সমুদ্র কেবল সৌন্দর্যের নয়, জীবন ও জীবিকার উৎস। কিন্তু এক কার্গো জাহাজের অবহেলায় সেই জীবনধারাই আজ হুমকির মুখে। ক্ষতিপূরণের লড়াই চললেও প্রকৃত ক্ষতির পূরণ আদৌ সম্ভব কিনা—সে প্রশ্নই এখন বড় হয়ে দেখা দিচ্ছে।
সূত্র: বিবিসি