Monday, June 23
Shadow

উন্নয়নের নামে হাজার কোটি টাকার লোপাট পায়রা বন্দরে

নিজস্ব প্রতিবেদক: পায়রা বন্দরের সক্ষমতা বৃদ্ধির লক্ষ্যে নেওয়া তিনটি বড় প্রকল্পে উন্নয়নের নামে দুর্নীতির মাধ্যমে অন্তত এক হাজার কোটি টাকা লোপাটের অভিযোগ উঠেছে। প্রায় ১৫ হাজার কোটি টাকার প্রকল্প ব্যয়ের পরেও কাঙ্ক্ষিত মানের উন্নয়ন হয়নি, বরং নানা অনিয়ম, দুর্নীতি ও সিন্ডিকেটের কারণে ব্যয়বহুল প্রকল্পগুলোতে হয়েছে নিম্নমানের কাজ।

বন্দর সংশ্লিষ্ট একাধিক সূত্রে জানায়, প্রকল্পগুলোর মাধ্যমে বন্দরের কাঙ্ক্ষিত গভীরতা নিশ্চিত না হওয়ায় এর পরিচালন কার্যক্রম মারাত্মকভাবে ব্যাহত হচ্ছে। বন্দরের বিভিন্ন পর্যায়ের অসাধু কর্মকর্তা ও ঠিকাদারদের যোগসাজশে প্রকল্পের অর্থ লোপাট করা হয়েছে।

তিন প্রকল্পের ব্যয়ের পরও উন্নয়ন প্রশ্নবিদ্ধ

পায়রা বন্দরের তিনটি প্রকল্প হলো— ক্যাপিটাল অ্যান্ড মেনটেইনেন্স ড্রেজিং স্কিম, পায়রা পোর্ট ফার্স্ট টার্মিনাল অ্যান্ড কানেকটিভিটি প্রজেক্ট, এবং ডেভেলপমেন্ট ইনফ্রাস্ট্রাকচার অ্যান্ড সাপোর্ট ফ্যাসিলিটিজ। মোট ব্যয় ধরা হয় প্রায় ১৫ হাজার কোটি টাকা। কিন্তু কাজের মান ও অগ্রগতি সে অনুযায়ী হয়নি।

ড্রেজিং প্রকল্পে অনিয়ম

৬ হাজার ৫০০ কোটি টাকার ড্রেজিং প্রকল্পে বেলজিয়ান কোম্পানি জান ডে নুল-এর সঙ্গে সরকারি নিয়ম উপেক্ষা করে ডিপিএম (ডাইরেক্ট প্রোকিউরমেন্ট মেথড) পদ্ধতিতে চুক্তি করা হয়। অথচ পিপিএ গাইডলাইনের আওতায় বিদেশি কোম্পানিকে ডিপিএম পদ্ধতিতে কার্যাদেশ দেওয়ার নিয়ম নেই।

এই প্রকল্পে কাজের আওতায় থাকা ৭৫ কিলোমিটারের চ্যানেলের পরিবর্তে মাত্র ৭০ কিলোমিটার ড্রেজিং করা হয়, সেটিও কাঙ্ক্ষিত ৯.৩ মিটার গভীরতায় পৌঁছায়নি। অথচ সম্পূর্ণ অর্থ তুলে নেওয়া হয়েছে। অভিযোগ রয়েছে প্রায় ২,৫০০ কোটি টাকার কাজ না করেই তুলে নেওয়া হয়েছে অর্থ। বর্তমানে বন্দরের নাব্যতা ৬ মিটারেও পৌঁছায়নি।

প্রকল্পে পাইলিং কেলেঙ্কারি

৪ হাজার কোটি টাকার পায়রা পোর্ট ফার্স্ট টার্মিনাল প্রকল্পে পরিচালক ছিলেন প্রধান প্রকৌশলী (সিভিল) মো. নাসির উদ্দিন। প্রকল্পে স্টিল পাইল ব্যবহারের কথা থাকলেও তা পরিবর্তন করে কংক্রিটের মাধ্যমে পাইলিং করা হয়, ফলে কয়েক শত কোটি টাকা লোপাট হয়েছে বলে অভিযোগ রয়েছে।

এছাড়া, ডিপিপি অনুযায়ী নির্দিষ্ট মানের বালু ব্যবহার না করে নিম্নমানের লোকাল বালু দিয়ে টার্মিনালের ব্যাকআপ ইয়ার্ড ভরাট করা হয়। এতে অতিরিক্ত শত কোটি টাকার দুর্নীতির অভিযোগ উঠেছে সংশ্লিষ্ট ঠিকাদার, প্রকৌশলী ও পরিচালকের বিরুদ্ধে।

২০২৪ সালের শুরুতে কাজ শেষ হওয়ার আগেই টার্মিনালের বাউন্ডারি দেওয়াল ধসে পড়লেও তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়নি। এতে অভিযুক্ত প্রকল্প পরিচালক নাসির উদ্দিনের ভূমিকা প্রশ্নবিদ্ধ হয়েছে। জানা যায়, তার বিরুদ্ধে দুর্নীতি দমন কমিশনে (দুদক) অনুসন্ধান চলছে।

প্রকল্প ব্যয় বাড়িয়ে সিন্ডিকেট লাভবান

২০১৯ সালে এই তিন প্রকল্পের অনুমোদন দেওয়া হয় এবং ২০২৪ সালের মধ্যে কাজ শেষ করার কথা ছিল। কিন্তু প্রকল্পের মেয়াদ ও ব্যয় একাধিকবার বাড়ানো হয়েছে। কাজের তুলনায় ব্যয় বেড়েছে কয়েক গুণ, আর উন্নয়ন হয়েছে কাগজে-কলমে। প্রকল্পগুলোতে দেশীয় প্রতিষ্ঠান ইনফ্রাদেব টেকনোলজি লিমিটেড ও কর্ণফুলী শিপইয়ার্ডের ভূমিকা নিয়েও রয়েছে প্রশ্ন।

কর্মকর্তাদের মন্তব্য মেলেনি

পায়রা বন্দর কর্তৃপক্ষের প্রধান প্রকৌশলী মো. নাসির উদ্দিন এবং সদস্য (প্রশাসন ও অর্থ) পরিমল চন্দ্র বসুর সঙ্গে একাধিকবার যোগাযোগের চেষ্টা করা হলেও তাদের মন্তব্য পাওয়া যায়নি।

পটুয়াখালীর কলাপাড়ায় অবস্থিত দেশের তৃতীয় সমুদ্রবন্দর পায়রা ২০১৩ সালে উদ্বোধন করা হয়। ২০১৬ সালে সীমিত পরিসরে কার্যক্রম শুরু হয় এবং ২০১৯ সালে পূর্ণ কার্যক্রম শুরু হয়। এরপর থেকে বন্দর দিয়ে কয়লা, নির্মাণসামগ্রীসহ বিভিন্ন বাণিজ্যিক মালামালের আমদানি-রপ্তানি চলমান রয়েছে।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *