
মোঃ জামাল হোসেন (শিক্ষা কার্যক্রম পরিচালক, ন্যাশনাল গার্লস মাদরাসা, ফেনী)
আরাফার রোজা মুসলিম উম্মাহর জন্য এক গুরুত্বপূর্ণ ইবাদত। রাসুল (সা.) বলেন, “আরাফার দিনে রোজা রাখলে এক বছর আগের ও এক বছর পরের গুনাহ ক্ষমা করে দেওয়া হয়।” (সহিহ মুসলিম)
কিন্তু প্রশ্ন হলো—এই “আরাফার দিন” কোন তারিখে? সৌদিতে যখন ৯ জিলহজ হয়, তখন বাংলাদেশে হয়তো হয় ৮ জিলহজ। তাহলে কি বাংলাদেশে সৌদির সময় অনুযায়ী রোজা রাখা উচিত? নাকি নিজেদের চাঁদ দেখার ভিত্তিতে ৯ জিলহজে?
এই প্রশ্নের উত্তর খুঁজে দেখতে পারি কোরআন, সহিহ হাদিস, ফিকহি ব্যাখ্যা এবং জ্যোতির্বিজ্ঞানে।
কোরআনে মাস গণনার জন্য চাঁদের গতিপথকেই নির্ভরযোগ্য মানা হয়েছে। আল্লাহ্ পবিত্র কোরআনে বলেন, “তিনি সূর্যকে দীপ্তিময় করেছেন এবং চন্দ্রকে করেছেন আলোকোজ্জ্বল, এবং এর জন্য তিনি মনযিল নির্ধারণ করেছেন, যাতে তোমরা বছরের হিসাব জানতে পারো।”
—(সূরা ইউনুস, ১০:৫)
এ আয়াত প্রমাণ করে, হিজরি মাস নির্ধারণ হয় চাঁদ দেখার ভিত্তিতে। পৃথিবীর বিভিন্ন স্থানে চাঁদ দেখা সময় ও ভৌগোলিক অবস্থানের কারণে এক-দুই দিন পার্থক্য হতে পারে।
রাসুল (সাঃ) বলেন, “আরাফার দিনে রোজা রাখলে আল্লাহ তা’আলা এক বছর আগের ও এক বছর পরের গুনাহ মাফ করে দেন।” (সহিহ মুসলিম, হাদিস ১১৬২)
এখানেই মূল কথা: “আরাফার দিন” মানে হিজরি ৯ জিলহজ। হাদিসে এই দিনটি নির্ধারণ করতে বলা হয়নি যে সেটা সৌদির তারিখে নির্ভর করবে।
সহিহ মুসলিমে একটি বিখ্যাত ঘটনা আছে (হাদিস ১০৮৭): সাহাবি কুরাইব সিরিয়ায় চাঁদ একদিন আগে দেখেন। মদিনায় ফিরে ইবনে আব্বাস (রা.)-কে জানালে তিনি বলেন: “আমরা আমাদের চাঁদ দেখা অনুযায়ী রোজা রাখব। আমাদের জন্য আমাদের চাঁদ দেখা যথেষ্ট।”
এ হাদিস প্রমাণ করে যে, স্থানীয় চাঁদ দেখা অনুযায়ী রোজা ও ঈদের দিন নির্ধারণ করাই হাদিসসম্মত পদ্ধতি।
বিজ্ঞান বলছে, চাঁদ পৃথিবীর চারপাশে ঘোরে এবং তার অবস্থান অনুযায়ী নতুন চাঁদ (new moon) পৃথিবীর বিভিন্ন স্থানে ভিন্ন ভিন্ন সময়ে দেখা যায়। সৌদি আরব বাংলাদেশের পশ্চিমে অবস্থিত, তাই সেখানে চাঁদ আগে দেখা যায় এবং তাদের হিজরি মাস আগে শুরু হয়। বাংলাদেশের মানুষদের জন্য ৯ জিলহজের দিন স্থানীয় চাঁদ দেখা অনুযায়ী ভিন্ন।
আধুনিক জ্যোতির্বিজ্ঞানও বলে—একই দিনে সারা পৃথিবীতে একসাথে চাঁদ দেখা যায় না। তাই একই তারিখে আরাফার দিন পালন করাও বাস্তবসম্মত নয়।
ইমাম ইবনে তাইমিয়া (রহ.) বলেন: “প্রত্যেক দেশের মানুষ তার নিজের চাঁদ দেখার ভিত্তিতে রোজা ও ঈদ পালন করবে। এতে এক-দুই দিনের পার্থক্য হলে কোনো সমস্যা নেই।” (ফাতাওয়া, ২৫/১০৭)
অন্য অনেক ফকীহ একমত যে, আরাফার রোজা সহ সব ইবাদত নিজস্ব চাঁদ দেখা অনুযায়ী নির্ধারণ করাই উত্তম ও শরিয়তসম্মত।
আরাফার রোজা হচ্ছে একটি মহান ইবাদত। কিন্তু সেই ইবাদতের গ্রহণযোগ্যতা নির্ভর করে সঠিক তারিখ নির্ধারণের ওপর। তাই কোরআন, হাদিস, বিজ্ঞান এবং ফিকহ— নির্দেশ করে—বাংলাদেশে আরাফার রোজা রাখতে হবে বাংলাদেশের ৯ জিলহজ তারিখে, সৌদি আরবের নয়।
ইসলামি স্কলারদের মধ্যে শাইখ ইবনে বায (রহ.) — প্রাক্তন গ্র্যান্ড মুফতি, সৌদি আরব, তার মতে- ❝যারা হজে যায়নি, তাদের জন্য আরাফার রোজা রাখা সুন্নত, আর এই রোজার দিন হলো স্থানীয়ভাবে ৯ জিলহজ। কারণ চাঁদ দেখা ভিন্ন ভিন্ন এলাকায় ভিন্ন হতে পারে, এবং শরিয়তের দিক থেকেও এটি গ্রহণযোগ্য।❞ উৎস: মাজমু ফাতওয়া ইবনে বাজ, ১৫/৪১৬।
শাইখ সালেহ আল মুনাজ্জিদ (saudi scholar and IslamQA.org প্রতিষ্ঠাতা) তার মতে – ❝আরাফার দিন নির্ধারিত হয় হিজরি ক্যালেন্ডারের ৯ জিলহজ হিসেবে, যা চাঁদ দেখার ভিত্তিতে হয়। তাই বিভিন্ন দেশে চাঁদ দেখার পার্থক্যের কারণে এই দিনটি এক দিন আগে বা পরে হতে পারে। এটা শরিয়তের দৃষ্টিতে বৈধ।❞
উৎস: islamqa.info/en/49007। তিনি সুস্পষ্টভাবে বলেছেন যে, “হজের আরাফা দিবস আর রোজার আরাফা দিবস আলাদা হতে পারে, কারণ রোজার বিষয়টি স্থানীয় সময় অনুসারে।”
কোরআন, সহিহ হাদিস, বিজ্ঞানের ব্যাখ্যা এবং ইসলামি স্কলারদের ঐকমত্য থেকে স্পষ্টভাবে প্রতীয়মান—বাংলাদেশে আরাফার রোজা পালন করতে হবে বাংলাদেশের চাঁদ দেখা অনুযায়ী ৯ জিলহজ তারিখে, সৌদির নয়। ইবাদতে ঐক্য প্রয়োজন, কিন্তু তা যেন হয় শরিয়তের মূলনীতির ভিত্তিতে, যুক্তি ও জ্ঞাননির্ভর সিদ্ধান্তের আলোকে। বিশ্বব্যাপী একতার নামে ভুল তারিখে রোজা পালন নয়, বরং সঠিক শরিয়তি পদ্ধতিতে রোজা পালনই হবে প্রকৃত অনুসরণ।