
মোঃ জামাল হোসেন (শিক্ষা কার্যক্রম পরিচালক, ন্যাশনাল গার্লস মাদরাসা)
গণিত মানেই কী ভয়?
বাংলাদেশে শিক্ষার্থীদের বড় একটি অংশের কাছে গণিত মানেই এক আতঙ্কের নাম। বিশেষ করে ষষ্ঠ থেকে দশম শ্রেণির শিক্ষার্থীদের মধ্যে “গণিতভীতি” যেন একটি সাধারণ সমস্যা। গণিত শেখার কৌশল, পাঠ্যবইয়ের কাঠামো ও কনটেন্ট, এবং শেখানোর পদ্ধতি নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে দীর্ঘদিন ধরে। বইয়ে ব্যাখ্যার অভাব, বাস্তব উদাহরণের ঘাটতি এবং কেবল সমাধাননির্ভর কাঠামো শিক্ষার্থীদের মধ্যে গণিত সম্পর্কে আগ্রহ তৈরি না করে, বরং চাপ তৈরি করছে বলেই মনে করেন অনেক শিক্ষক ও শিক্ষাবিদ।
গল্পহীন গানিতিক বাস্তবতা
জাতীয় শিক্ষাক্রম ও পাঠ্যপুস্তক বোর্ড (এনসিটিবি) প্রণীত ষষ্ঠ থেকে দশম শ্রেণির গণিত বইগুলোতে বিষয়বস্তুর উপস্থাপন কেবল নিয়ম এবং সূত্র-নির্ভর। উদাহরণ দেওয়া হলেও তার বেশিরভাগই যান্ত্রিক, শিক্ষার্থীর দৈনন্দিন জীবনের সঙ্গে সামঞ্জস্যহীন। এতে শিক্ষার্থীরা তিক্ত ও বিরক্ত হয়ে উঠে।তারা গনিতের উপর থেকে অগ্রহ হারিয়ে ফেলে।
উদাহরণস্বরূপ:
- ষষ্ঠ শ্রেণির গণিত (২০২৩ সংস্করণ)-এ ‘ভগ্নাংশ’ অধ্যায়ে বলা হয়েছে:
“রহিম ৪০ টাকার ২/৫ অংশ ব্যয় করল।”
এই ধরনের প্রশ্নে শিক্ষার্থীরা অংকের নিয়ম শিখে নেয়, কিন্তু বাস্তবে ২/৫ অংশ খরচের ধারণাটি কতটা ব্যবহারিক — তা অনুধাবন করতে পারে না।
- অষ্টম শ্রেণি, অধ্যায় ৫: সম্ভাবনা ও পরিসংখ্যান-এ ‘কয়েন নিক্ষেপ’ বা ‘ছক্কা ফেলা’র মতো উদাহরণ ব্যবহার করা হলেও, বাংলাদেশি শিক্ষার্থীদের বাস্তব জীবনে এমন বিষয়গুলোর খুব বেশি ব্যবহার বা অভিজ্ঞতা নেই। এতে সমস্যা হয়ে দাঁড়ায় “গাণিতিক যুক্তি” অনুধাবনের ক্ষেত্রে।
শিক্ষার্থী ও শিক্ষকের মতামত
চট্টগ্রামের অষ্টম শ্রেণির শিক্ষার্থী তাসনিম বলে:
“গণিতের অঙ্ক আমি মুখস্থ করি। কারণ বুঝে করলে সময় বেশি লাগে। পরীক্ষায় ভালো নম্বর পাওয়াটাই মুখ্য।”
ঢাকার এক গণিত শিক্ষক আবুল কালাম বলেন:
“বইয়ে বিশ্লেষণ নেই, গল্প নেই। একটি সূত্র, তারপর তিন-চারটি অঙ্ক। এতে করে শিক্ষার্থী সূত্র মুখস্থ করে সমাধান শিখে নেয়, কিন্তু গণিতের আসল সৌন্দর্য বোঝে না।”
বর্তমান পাঠ্যক্রমে স্কুল ও মাদরাসাগুলোতে শিক্ষার্থীরা বেশি নাম্বার তোলার প্রতিযোগিতায় মেতে উঠে। এখানে প্রকৃত শিক্ষা অর্জন মুখ্য হিসেবে তাদের কাছে থাকে না। এতে শিক্ষার্থীদের মধ্যে “যেভাবেই হোক ভালো নম্বর তুলতে হবে” প্রবণতা দেখা যায়। অনেক সময় দেখা যায়, শিক্ষকরা বোঝাতে না পেরে ‘উত্তর লিখে দিচ্ছেন’ — যা শিক্ষার্থীর বিশ্লেষণী চিন্তায় বাধা সৃষ্টি করে।
অন্যান্য দেশের কী অবস্থা?
বিদেশি শিক্ষাব্যবস্থায় গণিত শেখানোর সময় বাস্তব উদাহরণ, ছোট গল্প ও “ম্যাথ পাজল” দেওয়া হয়, যা শিক্ষার্থীকে সমস্যার সমাধান বের করতে উৎসাহিত করে। অথচ বাংলাদেশের পাঠ্যবইয়ে কোনো অধ্যায়েই গল্প বা কাহিনিভিত্তিক উপস্থাপনা নেই।
উদাহরণ হিসেবে পৃথিবীর অন্যান্য দেশের বইগুলোতে এভাবে উপস্থাপন করা হয়েছে। যেমনঃ “রিয়া একটি গল্প বই পড়ছে, প্রতিদিন ১/৫ অংশ করে। সে কত দিনে বইটি শেষ করবে?” — এতে সংখ্যা, সময় ও বাস্তব জীবনের অভ্যাস একসাথে শেখানো হয়েছে।
কী বলছে মনোবিজ্ঞান?
শিশু মনোবিজ্ঞানীরা বলেন, গণিত শেখার শুরুতে যদি শিশুদের মধ্যে আগ্রহ ও সম্পর্ক তৈরি না হয়, তাহলে তাদের মধ্যে গণিতভীতি বাড়তে থাকে। এর সঙ্গে যুক্ত হয় অভিভাবকের চাপ ও পরীক্ষার প্রতিযোগিতা। যা সত্যি কাম্য নয়।
এর জন্য আমরা কী করতে পারি?
১. পাঠ্যবইয়ে গল্পভিত্তিক সমস্যার অন্তর্ভুক্তি
২. স্থানীয় বাস্তবতার উদাহরণ ব্যবহার — যেমন, “একটি রিকশা ৩ কিমি যায়…” এমন উদাহরণ ছাত্রছাত্রীদের কাছে পরিচিত ও বোধগম্য হবে।
৩. বহুমাত্রিক মূল্যায়ন পদ্ধতি চালু করা – যেমন মডেল তৈরির মাধ্যমে অঙ্ক বোঝানো।
৪. শিক্ষকের প্রশিক্ষণ: শুধু পাঠ পড়ানো নয়, বরং “গণিতের ভাষা” শেখাতে পারদর্শী করে তোলা।
শুধু অঙ্ক কষে উত্তর পাওয়া নয়, গণিত শেখার উদ্দেশ্য হওয়া উচিত চিন্তাভাবনার বিকাশ, যুক্তির চর্চা। পাঠ্যবই যদি সেটির পথ তৈরি না করে, তাহলে শিক্ষার্থীরা পরীক্ষার চাপেই গণিতকে সীমাবদ্ধ করে ফেলবে — এবং “গণিত মানেই ভয়” — এই মানসিকতা আরও প্রগাঢ় হবে।