শাহজালাল সরকার:
প্রায় চার বছর ধরে ঢাকা শহরের শ্যামপুর-পোস্তগোলা এলাকায় রিকশা চালায় আজগর হোসেন। রিকশাটা নিজের নয়, ভাড়া করা। দিনশেষে যা রোজগার করে, এর নির্দিষ্ট একটা অংশ দিয়ে দিতে হয় মালিককে। আজগর হোসেনের গ্রামের বাড়ি মুন্সীগঞ্জের ভবেরচরে। শ্যামপুর রেল লাইনের পূর্ব পাশে স্ত্রী ও ছোট দুটি মেয়ে নিয়ে মাসিক ৩০০০ টাকা ভাড়ায় একটি টিনশেড ঘরে বসবাস করে আজগর। আনুমানিক বছরদেড়েক যাবৎ পেটের সমস্যায় ভুগছেন আজগর। পেটজ্বালা, বুকজ্বালা ও পেটব্যথা সহ আরও আছে গলার নিচের অংশে ঘা ঘা ভাব। সঙ্গীদের সাথে সে বিষয়টা নিয়ে শেয়ার করে প্রতিনিয়ত। সাথীদের কেউ কেউ ওষুধ সেবন করতে বলেন। আমাদের দেশে তো রোগীর চেয়ে চিকিৎসকের সংখ্যা বেশি! শরীরের একটা অসুবিধার কথা প্রকাশ করা মাত্রই অনেকে অনেক রকম ওষুধ খাওয়ার পরামর্শ দিতে দেরি করে না। আবার এ কথাও অনেকে বলেন, “ডাক্তারদের কাছে গিয়া কাম নাই। এক বোঝাই পরীক্ষা ধরে দেবে আর হাজার হাজার টাকা হাতিয়ে নেবে। তারা একবারের রোগ সারার কোন ওষুধ দেয় না। কারণ, একবারে রোগ ভালো হয়ে গেলে তো তাদের কাছে আর যাওয়া লাগবে না। আর তারাও বেশি বেশি ভিজিট পাবে না। তাই ডাক্তাররা ভাতে মরবে।
যা হোক, আজগর হোসেন বন্ধুবান্ধবদের পরামর্শ অনুযায়ী গ্যাস্ট্রিক সমস্যার বিভিন্ন ওষুধ সেবন করা শুরু করে দেয়। সে Entacyd থেকে শুরু করে Ranitidine, Famotidine, Pantoprazole, Omiprazole, Esomiprazole, জাতীয় ওষুধ সেবন করে চলেছে একের পর এক। যে যখন যা বলছে, তাই করে যাচ্ছে আর কি। তদুপরি তার রোগের আরোগ্যের কোন শুভ লক্ষণ দেখা দিচ্ছে না।
দিন দিন পেটের ব্যথা ও বুক জ্বালাপোড়া সমস্যাটা যেন বেড়েই চলেছে। কি করবে কিছুই বুঝে উঠতে পারছেন না আজগর। অবশেষে কোন একজন ভদ্রলোকের পরামর্শ অনুযায়ী ঢাকার একজন এমবিবিএস ডাক্তারকে বড় অঙ্কের টাকা ভিজিট দিয়ে চিকিৎসার শরণাপন্ন হন। ডাক্তারের পরামর্শ অনুযায়ী ওষুধ সেবন করে চলেছে দিনের পর দিন। কিন্তু দুঃখের বিষয় হচ্ছে, তাতেও তার রোগের কোন উন্নতি হচ্ছে না।
একে তো সে দিন এনে দিন খাওনের লোক, তার উপর চিকিৎসা বাবদ এত বেশি টাকা খরচ হওয়ার কারণে তার পরিবারের “নুন আনতে পান্তা ফুরায়” অবস্থা দেখা দিয়েছে।
একদিন দুপুরে রিকশা চালানো সমাপ্ত করে রিকশাটাকে গ্যারেজে ঢুকিয়ে হাতমুখ ধুয়ে প্রবেশ করে ফজলু মিয়ার ভাতের হোটেলে। আলুর ভর্তা আর ডাল দিয়ে ভাত খেতে আরম্ভ করে আজগর। ভাত খেতে তার যেন ভীষণ কষ্ট হচ্ছে! গলা ও বুক জ্বলে যাচ্ছে! পাশে বসা এক কারখানার এক ছোট কর্তা আজগরের এ অবস্থা দেখে বলে উঠলেন, “কিরে ভাই! আপনি এমন করছেন কেন? মনে হয় খুব অসুস্থ!” “আর কইয়েন না ভাই’ আজ এক বছর ধইরা পেটের অসুবিধায় ভুগতাছি। কত ট্যাহা-পইসা যে ডাক্তারগোরে দিলাম, তার কিছুই বুঝতাছি না। এক পাল্লায় যদি ট্যাহাডিরে উডাই, আর এক পাল্লায় যদি আমি উডি, তয় ট্যাহার ওজন বেশি হইবো। এত ট্যাহা খরচ কইরাও কোন উপকার পাই নাই। এখন কি করুম আর বুঝে উঠতে পারতাছিনা।”
আজগর হোসেনের এসব কথা শুনে লোকটি একটু ভাবনায় পড়ে গেলেন এবং ক্ষণিক পর বললেন, “নিরাশ হবেন না ভাই। আমি যদি আপনাকে একটা পরামর্শ দিই, তবে কি শুনবেন?”
আজগর বলল, “কি পরামর্শ, বলেন তো ভাই!” লোকটি বললেন, “শোনেন ভাই, আমার জানা একজন ভালো ডাক্তার আছেন। উনি ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের একজন প্রফেসর। ওনার নাম ডাক্তার শহিদুল ইসলাম চৌধুরী। আমার কাছে ওনার ভিজিটিং কার্ড আছে। আপনার যে সমস্যা, ওনি এই বিষয়েরই ডাক্তার। আর দেরি না করে আপনি ওনাকে তাড়াতাড়ি দেখান। তবে ওনাকে সিরিয়াল দিলে আপনি দেখানোর সুযোগ পাবেন প্রায় মাস তিনেক পর। আর ওনার এক নিকট আত্মীয়কে দিয়ে আমি কালই দেখানোর ব্যবস্থা করতেছি।”
যেই কথা সেই কাজ। পরদিন বিকেল পাঁচটায় আজগর হোসেন সোজা চলে গেলেন ডাক্তার শহিদুল ইসলাম সাহেবের চেম্বারে। ডাক্তার সাহেব আজগরের যাবতীয় Case History ও পূর্বের যাবতীয় রিপোর্ট এবং Prescription দেখে নতুন কোন পরীক্ষা না দিয়ে একটা ব্যবস্থা পত্র লিখে দিলেন এবং বললেন, “একটানা দুই মাস ওষুধ খাবেন। উন্নতি না হলে দুই মাস পর আবার দেখা করবেন। ভালো হয়ে গেলে আর আসার দরকার নেই।” ব্যবস্থাপত্রটি নিম্নরূপঃ
Rx,
Tab. Riboson
2+0+2…………২মাস (আহারের পর সেব্য)
ডাক্তার সাহেব ভিজিট নিলেন ১০০০ টাকা। ডাক্তারের চেম্বার ত্যাগ করে আজগর ফার্মেসিতে গিয়ে ব্যবস্থাপত্রটা দিলেন ওষুধ কেনার জন্য। আর বিক্রেতাকে বললেন, “ওষুধগুলো কি আপনার কাছে আছে?” ওষুধ বিক্রেতা বললেন, “আছে। কয় দিনের নিবেন।?” আজগর মনে মনে ভাবে, “অল্প কিছু দিনের নিয়া খাইয়া দেহি। একবারে নিমু কি দিয়া? তারপর বিক্রেতাকে বললেন, ভাই কয়দিনের ওষুধ লিখছে?” “দুই মাসের ওষুধ।” ” বলেন কী?” ওষুধ বিক্রেতাকে আজগর বললেন, “কয় পদের ওষুধ ভাই?” “এক পদ ট্যাবলেট।” “মাত্র এক পদ ওষুধ লেখছে ভাই? কত কইরা পাতা?” “দুই টাকা পাতা।” “কী? আপনার মাথা ঠিক আছেনি মিয়া? ভালা কইরা দেখেন।” ওষুধ বিক্রেতা এবার বললেন, “এই মিয়া, আপনার সাথে এত বকবক করতে পারবো না। আমার সময় নেই। অন্য কাস্টমারের ক্ষতি হচ্ছে। আপনি ওষুধ নিলে নেন, না নিলে চলে যান।”
একথা শুনে আজগরের মাথা খারাপ অবস্থা। মনে মনে ভাবে, “এক হাজার ট্যাহার ভিজিট দিলাম আর ওষুধ লিখছে মাত্র দুই ট্যাহার! ডাক্তার সাব মনে হয় ভুল করছে! ভুল তো করারই কথা! এত রোগী তারা দ্যাহে যে, সব কথা কি তাগোর মনে থাহে?”
কাল বিলম্ব না করে আজগর সোজা আবার চলে যায় ডাক্তার সাহেবের চেম্বারে। কথার কোন ভূমিকা না টেনে বলেই ফেললো, “ডাক্তার সাব, আমার মনে হয় আপনি ভুল করছেন। ঔষধ লিখতে আপনার ভুল হইয়া গেছে। আবার লেইখ্যা দেন।”
আজগরের কথা শুনে ডাক্তার সাহেব তাকে এক ধমক দিয়ে সোজা বেড়িয়ে যাওয়ার নির্দেশ দিলেন আর বললেন, “ঔষধ যা লিখেছি নিয়মিত খাবেন আর তাতে না সারলে দুমাস পর আবার দেখিয়ে যাবেন। যান!”
আজগর হোসেনের ভক্তি বিশ্বাস হলো না এই ডাক্তারের উপর। সে ভাবতে থাকে, “হাজার হাজার ট্যাহার কত দামি দামি ওষুধ খাইলাম তাতে কোন কাম অইলো না। আর দুই ট্যাহার ওষুধে বুঝি রোগ ভালা হইবো?”
আজগর মুরুব্বিদের কাছ থেকে জেনে এসেছে, যেসব ওষুধে ভক্তি বিশ্বাস না থাকে সেই ওষুধে কোন কাজ হয় না। তারপরেও সে তার মনের বিরুদ্ধেই ডাক্তার সাহেবের দেওয়া ব্যবস্থাপত্রের Tab. Riboson ঔষধ খাওয়া শুরু করেছে। ওষুধ খাওয়ার প্রায় ১০ দিনের মাথায় আজগর হোসেন কিছুটা সুস্থতা অনুভব করছে। বিশ দিন পর তার পেটের, বুকের আর গলার অভ্যন্তরের সমস্যাগুলোর উন্নতি হতে শুরু করেছে। এভাবে পুরো টানা দু’মাস ঔষধ খেয়ে সে সম্পূর্ণ সুস্থ হয়ে গেল। আর কোনদিনও ওই ডাক্তারের কাছে তার যাওয়ার প্রয়োজন পড়ে নি।
শাহজালাল সরকার, পাহাড়পুর, মুরাদনগর, কুমিল্লা।