
কুরআন ও সহিহ হাদিসের আলোকে বিস্তারিত ব্যাখ্যা
মোঃ জামাল হোসেন। (শিক্ষা কার্যক্রম পরিচালক) ন্যাশনাল গার্লস মাদরাসা।
ইসলামে সময়ের গুরুত্ব অপরিসীম। আল্লাহ তাআলা কিছু সময়কে অন্য সময়ের ওপর শ্রেষ্ঠত্ব দিয়েছেন। যেমন, রমজান মাস, লাইলাতুল কদর, আশুরা—ঠিক তেমনি জিলহজ মাসের প্রথম দশ দিন হলো ইসলামের সর্বশ্রেষ্ঠ দিনগুলোর অন্তর্ভুক্ত। রাতের দিক দিয়ে রমজানের শেষ দশ দিন আর দিনের দিক দিয়ে জিলহজ মাসের প্রথম দশ দিন। এই দিনগুলোতে আল্লাহ তাআলার পক্ষ থেকে রহমত, বরকত ও মাগফিরাতের দরজা উন্মুক্ত থাকে। রাসুলুল্লাহ (সাঃ) স্বয়ং এই দিনগুলোর ফজিলত বিশেষভাবে বর্ণনা করেছেন এবং তাঁর উম্মতকে এগুলো যথাযথভাবে কাজে লাগাতে উৎসাহ দিয়েছেন।
কুরআনে এই দশ দিনের মর্যাদা
আল্লাহ তাআলা সূরা আল-ফজরে বলেন:
وَٱلۡفَجۡرِ (١) وَلَيَالٍ عَشۡرٍ (٢)
“শপথ ফজরের, এবং দশ রাতের।”
(সূরা আল-ফজর: আয়াত ১-২)
মুফাসসিরগণ, বিশেষ করে ইবন আব্বাস (রাঃ), কাতাদা, মুজাহিদ, এবং ইবনু কাসীর (রহঃ) এই “দশ রাত” বলতে জিলহজ মাসের প্রথম দশ দিন বুঝিয়েছেন। (তাফসির ইবন কাসীর)
রাসুলুল্লাহ (সাঃ) এর হাদিসে এই দশ দিনের ফজিলত
১. সেরা দিন:
“আল্লাহর কাছে এমন কোনো দিন নেই যাতে নেক আমল এই দশ দিনের চেয়ে অধিক প্রিয় হয়।”
সাহাবিরা বললেন, “হে আল্লাহর রাসুল! জিহাদও নয়?”
তিনি বলেন,
“জিহাদও নয়—তবে সেই ব্যক্তি ব্যতীত যে নিজের প্রাণ ও ধন নিয়ে (আল্লাহর রাস্তায়) বের হয়ে কিছুই ফিরিয়ে আনেনি।”
(সহিহ বুখারি, হাদিস: ৯৬৯)
২. এই দিনগুলোতে আল্লাহর জিকির বেশি বেশি করার নির্দেশ দেয়া হয়েছে:
রাসুল (সাঃ) বলেন,
“তোমরা এই দশ দিনে বেশি বেশি ‘তাহলিল’ (লা ইলাহা ইল্লাল্লাহ), ‘তাকবির’ (আল্লাহু আকবার), এবং ‘তাহমিদ’ (আলহামদুলিল্লাহ) বলো।”
(মুসনাদে আহমদ, হাদিস: ৫৪৪৬)
৩. আরাফার রোজা:
রাসুলুল্লাহ (সাঃ) বলেন,
“আরাফা দিবসে (৯ জিলহজ) রোজা রাখলে আগের এক বছর এবং পরের এক বছরের গোনাহ মাফ হয়ে যায়।”
(সহিহ মুসলিম, হাদিস: ১১৬২)
৪. হজ ও কুরবানির সকল কার্যক্রম এই দশ দিনেই হয়:
এই দশ দিনের ভেতরই হজের মূল কার্যক্রম সম্পন্ন হয় — তাওয়াফ, সাঈ, আরাফায় অবস্থান, কুরবানি, জামারায় রমি ইত্যাদি। ইসলামের গুরুত্বপূর্ণ বিধান কুরবানি এই দশম দিনে (ঈদুল আযহা) আদায় হয়।
৫. আরাফা দিবসে আল্লাহ সবচেয়ে বেশি বান্দাকে ক্ষমা করেন:
রাসুল (সাঃ) বলেন,
“আল্লাহ তাআলা আরাফা দিবসের চেয়ে বেশি কোনো দিন বান্দাদের জাহান্নাম থেকে মুক্তি দেন না।”
(সহিহ মুসলিম, হাদিস: ১৩৪৮)
এই দিনগুলো গুরুত্ব
- এই দিনগুলোতে সালাত, রোজা, দান-সদকা, হজ, কুরবানি, জিকির — সকল শ্রেষ্ঠ ইবাদত একসঙ্গে সম্পন্ন হয়।
- একমাত্র এই দশ দিনেই একই সময়ে হজ, কুরবানি এবং আরাফা দিবসের মতো গুরুত্বপূর্ণ আমল হয়, যা বছরের অন্য কোন সময় হয় না।
- এই দিনগুলোতে আল্লাহর কাছে দোয়া কবুল হয়, গোনাহ মাফ হয়, আমলের সওয়াব বাড়িয়ে দেওয়া হয়।
এই দিনে সাহাবাগণের আমল ছিল বেশি
- সাহাবিগণ এই দিনগুলোতে বেশি বেশি নফল নামাজ, কুরআন তিলাওয়াত, রোজা ও তাকবির বলতেন।
- বাজারে গিয়ে উঁচু স্বরে “আল্লাহু আকবার, লা ইলাহা ইল্লাল্লাহ” বলতেন এবং অন্যদেরও জিকিরে উদ্বুদ্ধ করতেন।
(বুখারি, খণ্ড ২, পৃষ্ঠা ২০)
আমাদের করণীগুলো কী?
নামাজ: সময়মতো ফরজ ও নফল নামাজ আদায়।
রোজা: বিশেষ করে ৯ জিলহজ (আরাফা) রোজা।
কুরআন তিলাওয়াত ও জিকির
তাকবির বলা:
“আল্লাহু আকবার, আল্লাহু আকবার, লা ইলাহা ইল্লাল্লাহ, আল্লাহু আকবার, আল্লাহু আকবার, ওয়ালিল্লাহিল হামদ।”
সদকা ও দান
কুরবানি: সামর্থ্য অনুযায়ী পশু কোরবানি করা
তওবা ও দোয়া: গুনাহ মাফ চাওয়া, দোয়া করা
জিলহজ মাসের প্রথম দশ দিন ইসলামের দৃষ্টিতে বছরের সবচেয়ে পুণ্যময় সময়। এই সময়কে হেলায় হারালে জীবন থেকে অমূল্য সওয়াব হারিয়ে যেতে পারে। রাসুল (সাঃ) এর সুন্নাহ অনুসরণ করে আমরা যদি এই সময়টা বেশি বেশি ইবাদত, দোয়া ও আত্মশুদ্ধিতে ব্যয় করি, তাহলে দুনিয়া ও আখিরাতে এর ফল আমরা নিশ্চয়ই পাবো।
আল্লাহ যেন আমাদের সবাইকে এই বরকতময় সময় সঠিকভাবে কাজে লাগানোর তাওফিক দেন। আমিন।