Saturday, May 10
Shadow

ধনী দেশগুলো কি আসলেই জলবায়ু পরিবর্তন মোকাবিলা করতে চায়?

রাকিব হোসেন: বাংলাদেশসহ বিশ্বের অনেক দেশে জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব দিন দিন তীব্র থেকে তীব্রতর হচ্ছে—বন্যা, খরা, ঘূর্ণিঝড় ও লবণাক্ততা আমাদের মতো দেশের খাদ্যনিরাপত্তা ও জীবিকাকে হুমকির মুখে ফেলছে। কিন্তু কীভাবে আমরা এই সংকট মোকাবিলা করব? আমাদের সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ কি মানুষের মধ্যে সচেতনতার অভাব? গবেষণা বলছে, মোটেও না। ১২৫টি দেশের ১ লাখ ৩০ হাজার মানুষের ওপর করা একটি আন্তর্জাতিক জরিপে দেখা গেছে, বেশিরভাগ মানুষ মনে করে আমাদের জীবনযাত্রা এবং সমাজের কাঠামো আমূল বদলানো ছাড়া জলবায়ু সমস্যার সমাধান সম্ভব নয়। এমনকি তারা বলেছেন, প্রয়োজনে নিজের আয়ের অন্তত ১% জলবায়ু কার্যক্রমে দিতে তারা প্রস্তুত। অর্থাৎ, মানুষ ইতোমধ্যেই জলবায়ু পরিবর্তন সম্পর্কে সচেতন—তাদের আর নতুন করে বোঝাতে হবে না যে এটি একটি বড় সমস্যা। চ্যালেঞ্জটা এখন অন্যখানে: কীভাবে আমরা সেই বিদ্যমান সচেতনতা ও উদ্বেগকে কার্যকর ও সমষ্টিগত পদক্ষেপে রূপান্তর করতে পারি? তবে এই সংকটের মূল কারণ হিসেবে ধনী দেশগুলোর অতিরিক্ত কার্বন নিঃসরণ ও প্রাকৃতিক সম্পদের অপব্যবহারকে চিহ্নিত করা হয়েছে। একটি সাম্প্রতিক গবেষণায় দেখা গেছে, বিশ্বের সবচেয়ে ধনী ১০% মানুষ ১৯৯০ সাল থেকে বৈশ্বিক উষ্ণায়নের প্রায় দুই-তৃতীয়াংশের জন্য দায়ী।

যুক্তরাষ্ট্র, কানাডা, জাপান ও ইউরোপের পশ্চিমাঞ্চলের একটি বড় অংশজুড়ে বিশ্বের মোট জনসংখ্যার মাত্র ১২ শতাংশের বসবাস। অথচ এ দেশগুলোই বিশ্বের মোট কার্বন নিঃসরণের ৫০ শতাংশের জন্য দায়ী। ১৭০ বছর ধরে জীবাশ্ম জ্বালানি পুড়িয়ে বৈশ্বিক উষ্ণতা বৃদ্ধিতে ভূমিকা রেখে যাচ্ছে দেশগুলো। এ সময়ের মধ্যে ১ দশমিক ১ ডিগ্রি সেলসিয়াস হারে বেড়েছে বৈশ্বিক উষ্ণতা। আর এর ফলে বিশ্বে ঘটছে প্রচণ্ড তাপপ্রবাহ, বন্যা, খরা ও দাবানলের ঘটনা।

এই ধনী ১০% মানুষের জীবনযাত্রা ও বিনিয়োগের ধরণ জলবায়ু পরিবর্তনকে ত্বরান্বিত করছে, যার প্রভাব সবচেয়ে বেশি পড়ছে দরিদ্র দেশগুলোর ওপর । ধনী দেশগুলোর ইকোলজিক্যাল ফুটপ্রিন্টও অত্যন্ত বেশি। চীন, যুক্তরাষ্ট্র ও ভারত বিশ্বের সর্বাধিক ইকোলজিক্যাল ফুটপ্রিন্টধারী দেশগুলোর মধ্যে রয়েছে । এই অতিরিক্ত সম্পদ ব্যবহার ও দূষণ দরিদ্র দেশগুলোর জন্য পরিবেশগত ও অর্থনৈতিক চ্যালেঞ্জ সৃষ্টি করছে।

যদিও ধনী দেশগুলো জলবায়ু পরিবর্তন মোকাবিলায় আর্থিক সহায়তার প্রতিশ্রুতি দিয়েছে, বাস্তবে তা প্রায়ই অপর্যাপ্ত ও বিলম্বিত হয়েছে। এক দশক আগে বিশ্বের ধনী দেশগুলো প্রতিশ্রুতি দিয়েছিল, জলবায়ুর পরিবর্তনজনিত পরিস্থিতি মোকাবিলায় দরিদ্র দেশগুলোকে ২০২০ সাল নাগাদ বছরে ১০০ বিলিয়ন ডলার সহায়তা দেওয়া হবে। তবে সেই প্রতিশ্রুতি তারা ধরে রাখতে পারেনি। এ তহবিলে শতকোটি ডলার বার্ষিক ঘাটতি থেকেই যাচ্ছে। বন্যা ও খরার জন্য আগাম সতর্কতাব্যবস্থা স্থাপনসহ বিভিন্ন পদক্ষেপের জন্য দরিদ্র দেশগুলো যে সহায়তা পায়, তা–ও যৎসামান্য। ২০০৯ সালে প্রতিশ্রুত $১০০ বিলিয়ন বার্ষিক সহায়তা ২০২২ সালে পূরণ করা হয়েছে, যা দরিদ্র দেশগুলোর জন্য প্রয়োজনীয় অর্থের তুলনায় অনেক কম । এমনকি, এই সহায়তার একটি বড় অংশ ঋণ হিসেবে প্রদান করা হয়েছে, যা দরিদ্র দেশগুলোর ওপর অতিরিক্ত আর্থিক চাপ সৃষ্টি করছে ।

শিল্প কার্যক্রম, ভারী যন্ত্রপাতি ও যানবাহন ধনী দেশগুলোতে সবচেয়ে বড় দূষণের উৎস। এই উৎপাদন প্রক্রিয়া স্থানীয় ও আন্তর্জাতিক বাজারে পণ্য সরবরাহ করে, যা ধনী দেশগুলোর অর্থনীতিকে সমৃদ্ধ করে। অন্যদিকে, দরিদ্র দেশগুলো, যারা এই দূষণে অবদান রাখে না, তারা জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাবের শিকার হচ্ছে। তাহলে কি জলবায়ু পরিবর্তন মোকাবিলায় ধনী দেশগুলো তাদের উৎপাদন কমিয়ে দেবে?  উৎপাদন হ্রাস করা সমাধান নয়, কারণ এটি বৈশ্বিক সরবরাহ চেইনকে ব্যাহত করবে এবং বাজারে মূল্যবৃদ্ধি ও ঘাটতির সৃষ্টি করবে। বরং, সমাধান হলো ক্ষতিপূরণ প্রদান। ধনী দেশগুলোর উচিত দরিদ্র দেশগুলোর জন্য পর্যাপ্ত আর্থিক সহায়তা ও প্রযুক্তিগত সহায়তা প্রদান করা, যাতে তারা জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব মোকাবিলা করতে পারে। জলবায়ু পরিবর্তন মোকাবিলায় ধনী দেশগুলোর আরও কার্যকর, ন্যায্য ও দায়িত্বশীল ভূমিকা প্রয়োজন। তাদের উচিত, দরিদ্র দেশগুলোর সঙ্গে সহযোগিতা বৃদ্ধি করা, প্রতিশ্রুত অর্থায়ন সময়মতো প্রদান করা এবং বৈশ্বিক উষ্ণায়ন রোধে কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণ করা। শুধুমাত্র তখনই আমরা একটি টেকসই ও ন্যায়সঙ্গত ভবিষ্যতের দিকে এগিয়ে যেতে পারব।

এ অবস্থায় নতুন সামাজিক নিয়ম তৈরি করতে হলে প্রয়োজন ধনীদের ও নেতাদের দৃশ্যমান নেতৃত্ব। অর্থনৈতিক গবেষণায় দেখা যায়, মানুষ যখন দেখে সবার অংশগ্রহণ নিশ্চিত হচ্ছে, তখন সরকারি ভর্তুকি বা পরিবেশবান্ধব নীতির পক্ষে বেশি সমর্থন দেয়। বিশেষ করে নিম্নআয়ের মানুষদের অন্তর্ভুক্তি নিশ্চিত করা গেলে সামাজিক গ্রহণযোগ্যতা বহুগুণে বাড়ে। জলবায়ু পরিবর্তন একটি বৈশ্বিক সমস্যা, যার সমাধানও বৈশ্বিকভাবে করতে হবে। ধনী দেশগুলোর উচিত তাদের অতীত ও বর্তমান নিঃসরণের জন্য দায়িত্ব স্বীকার করা এবং দরিদ্র দেশগুলোর পাশে দাঁড়ানো। এই দায়িত্ব পালন না করলে, বৈশ্বিক ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠা সম্ভব নয়।

রাকিব হোসেন
গবেষক ও উন্নয়নকর্মী
পিএইচডি ফেলো (অর্থনীতি), খুলনা বিশ্ববিদ্যালয়

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *