
সাদিয়া সুলতানা রিমি, শিক্ষার্থী, গণিত বিভাগ, জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয় : গণিত, মানব সভ্যতার বিকাশে এক অবিচ্ছেদ্য অংশ। প্রাচীনকাল থেকে শুরু করে আধুনিক বিজ্ঞানের প্রায় প্রতিটি শাখায় গণিতের অবদান অনস্বীকার্য। তবে একবিংশ শতাব্দীতে এসে গণিত শিক্ষার প্রচলিত ধারায় এক নতুন দিগন্ত উন্মোচিত হয়েছে, আর তা হলো কোডিং। কোডিং, যা মূলত কম্পিউটার প্রোগ্রামিংয়ের একটি অংশ, এখন গণিত শিক্ষাকে আরও কার্যকরী, বাস্তবমুখী এবং আনন্দদায়ক করে তোলার এক শক্তিশালী হাতিয়ার হিসেবে পরিগণিত হচ্ছে।
প্রথমেই এই প্রশ্নটি আসতে পারে যে, গণিত এবং কোডিং কীভাবে একে অপরের পরিপূরক হতে পারে? উত্তরটা খুব সহজ। কোডিংয়ের মূল ভিত্তিই হলো গাণিতিক যুক্তি এবং সমস্যা সমাধানের দক্ষতা। একটি কম্পিউটার প্রোগ্রাম লিখতে গেলে ধাপে ধাপে সমস্যা বিশ্লেষণ করতে হয়, অ্যালগরিদম তৈরি করতে হয় এবং যৌক্তিক সিদ্ধান্ত নিতে হয়। এই প্রক্রিয়াগুলো সরাসরি গাণিতিক চিন্তাভাবনার সাথে সম্পর্কিত। গণিতে আমরা যে বিমূর্ত ধারণাগুলো শিখি, কোডিং সেগুলোকে বাস্তব রূপ দিতে সাহায্য করে। যেমন, বীজগণিতের সূত্রগুলো কোডিংয়ের মাধ্যমে একটি ফাংশন হিসেবে লেখা যায়, জ্যামিতিক চিত্রগুলো কোডিংয়ের সাহায্যে আঁকা যায়, এবং পরিসংখ্যানের ডেটা বিশ্লেষণ করা যায় প্রোগ্রামিংয়ের মাধ্যমে।
বিমূর্ত ধারণাগুলোকে মূর্ত করে তোলা: কোডিংয়ের মাধ্যমে ভিজ্যুয়ালাইজেশন
গণিতের একটি বড় চ্যালেঞ্জ হলো এর বিমূর্ত ধারণাগুলো শিক্ষার্থীদের কাছে বোধগম্য করে তোলা। অনেক সময় শিক্ষার্থীরা গাণিতিক সূত্র বা উপপাদ্যের পেছনের যুক্তি বুঝতে পারে না, কারণ তারা সেগুলোর বাস্তব প্রয়োগ দেখতে পায় না। কোডিং এই সমস্যা সমাধানে এক অসাধারণ ভূমিকা পালন করে। কোডিংয়ের মাধ্যমে জটিল গাণিতিক ধারণাগুলো দৃশ্যমান (visual) করে তোলা সম্ভব।
উদাহরণস্বরূপ, ফাংশনের লেখচিত্র (graph) হাতে এঁকে বুঝতে যতটা সময় লাগে, কোডিংয়ের মাধ্যমে সেটি মুহূর্তেই তৈরি করে বিভিন্ন প্যারামিটার পরিবর্তন করে এর আচরণ দেখা সম্ভব। পিয়াজির তত্ত্ব অনুসারে, শিশুরা যখন কোনো কিছু হাতে-কলমে করে বা দেখে শেখে, তখন তাদের জ্ঞান স্থায়ী হয়। কোডিং এই সুযোগটি করে দেয়। বীজগণিতের সমীকরণ সমাধানের ধাপগুলো একটি প্রোগ্রামের মাধ্যমে দেখানো যায়, ত্রিকোণমিতির কোণ ও বাহুর সম্পর্ককে অ্যানিমেশনের মাধ্যমে উপস্থাপন করা যায়, এমনকি ক্যালকুলাসের জটিল ধারণা যেমন ডেরিভেটিভ ও ইন্টিগ্রেশনকে গতিশীল চিত্রের মাধ্যমে দেখানো সম্ভব। এতে শিক্ষার্থীরা কেবল সূত্র মুখস্থ না করে সেগুলোর অন্তর্নিহিত অর্থ এবং কার্যকারিতা উপলব্ধি করতে পারে।
গণিত শেখার একটি প্রধান উদ্দেশ্য হলো সমস্যা সমাধানের দক্ষতা অর্জন করা। কোডিং এই দক্ষতাকে আরও শাণিত করে। একটি প্রোগ্রাম লেখার সময় শিক্ষার্থীদেরকে একটি সমস্যাকে ছোট ছোট অংশে ভাগ করতে হয়, প্রতিটি অংশের জন্য সমাধান খুঁজতে হয় এবং সেগুলোকে একটি নির্দিষ্ট ক্রমে সাজিয়ে একটি কার্যকর অ্যালগরিদম তৈরি করতে হয়। এই প্রক্রিয়াটি হুবহু গণিতের সমস্যা সমাধানের মতোই।
কোডিংয়ের মাধ্যমে শিক্ষার্থীরা শিখতে পারে কীভাবে একটি সমস্যাকে ধাপে ধাপে বিশ্লেষণ করতে হয়, সম্ভাব্য সব উপায় নিয়ে ভাবতে হয় এবং সবচেয়ে কার্যকর সমাধানটি খুঁজে বের করতে হয়। এখানে “যদি-তবে” (if-else) শর্ত, লুপ (loop) এবং ফাংশন ব্যবহারের মাধ্যমে শিক্ষার্থীরা যৌক্তিক সিদ্ধান্ত গ্রহণ এবং কাঠামোবদ্ধ চিন্তাভাবনার অভ্যাস গড়ে তোলে। এটি কেবল তাদের গণিতেই নয়, জীবনের অন্যান্য ক্ষেত্রেও সিদ্ধান্ত গ্রহণে এবং সমস্যা সমাধানে সাহায্য করে। যখন তারা একটি কোড লেখে এবং সেটি কাজ না করে, তখন তারা এর কারণ খুঁজে বের করতে শেখে, যা ডিবাগিং (debugging) নামে পরিচিত। এই ডিবাগিং প্রক্রিয়া শিক্ষার্থীদের মধ্যে অধ্যবসায় এবং সমালোচনামূলক চিন্তাভাবনার জন্ম দেয়।
ভুল থেকে শেখা এবং পুনরাবৃত্তিমূলক প্রক্রিয়া:
গণিত শেখার ক্ষেত্রে ভুল করা একটি স্বাভাবিক প্রক্রিয়া, কিন্তু অনেক সময় শিক্ষার্থীরা ভুলের কারণে হতাশ হয়ে পড়ে। কোডিং এই ধারণাকে বদলে দেয়। প্রোগ্রামিংয়ে ভুল করা বা এরর (error) আসা একটি সাধারণ ঘটনা। শিক্ষার্থীরা যখন একটি কোড লেখে এবং তাতে ভুল আসে, তখন তারা সেটিকে একটি শেখার সুযোগ হিসেবে দেখে। তারা ভুলগুলো চিহ্নিত করে, সমাধানের চেষ্টা করে এবং বারবার চেষ্টা করে সঠিক আউটপুট না পাওয়া পর্যন্ত। এই পুনরাবৃত্তিমূলক প্রক্রিয়া (iterative process) শিক্ষার্থীদের মধ্যে ধৈর্য, অধ্যবসায় এবং নির্ভুলতার গুরুত্ব শেখায়।
গণিতে, একটি ভুল উত্তরের পর পুনরায় পুরো সমস্যাটি নতুন করে করা বেশ সময়সাপেক্ষ হতে পারে। কিন্তু কোডিংয়ে, সামান্য পরিবর্তন করে বারবার পরীক্ষা করার সুযোগ থাকে, যা শিক্ষার্থীদের দ্রুত শিখতে এবং আত্মবিশ্বাস বাড়াতে সাহায্য করে। এই পদ্ধতি তাদের গণিতের প্রতি ভয় কমিয়ে দেয় এবং একটি ভুলকে শেখার ধাপ হিসেবে দেখতে উৎসাহিত করে।
বাস্তব জীবনের প্রয়োগ: গণিতের ব্যবহারিক দিক উন্মোচন
অনেক শিক্ষার্থী মনে করে গণিত কেবল কিছু সূত্র আর সংখ্যার জটিল খেলা, এর সাথে বাস্তব জীবনের কোনো সম্পর্ক নেই। কোডিং এই ধারণাকে সম্পূর্ণরূপে পরিবর্তন করে দেয়। কোডিংয়ের মাধ্যমে শিক্ষার্থীরা গণিতের ধারণাগুলোকে বাস্তব বিশ্বের সমস্যা সমাধানে ব্যবহার করতে পারে।
উদাহরণস্বরূপ, আবহাওয়ার পূর্বাভাস মডেল তৈরি করা, শেয়ার বাজারের প্রবণতা বিশ্লেষণ করা, গেম ডিজাইন করা, রোবট নিয়ন্ত্রণ করা, ডেটা ভিজ্যুয়ালাইজেশন তৈরি করা – এই সবকিছুর মূলে রয়েছে গণিত এবং কোডিং। যখন শিক্ষার্থীরা কোডিংয়ের মাধ্যমে একটি সাধারণ ক্যালকুলেটর তৈরি করে অথবা একটি সহজ গেম ডিজাইন করে, তখন তারা গণিতের বাস্তব প্রয়োগ উপলব্ধি করতে পারে। এতে তাদের গণিত শেখার আগ্রহ বহুগুণ বেড়ে যায়, কারণ তারা দেখতে পায় যে গণিত কেবল বইয়ের পাতায় সীমাবদ্ধ নয়, বরং এটি প্রতিদিনের জীবনে অত্যন্ত কার্যকরী।
গণিতকে প্রায়শই একটি কঠিন এবং কম সৃজনশীল বিষয় হিসেবে দেখা হয়। তবে কোডিং গণিতকে সৃজনশীলতার এক নতুন মঞ্চ প্রদান করে। যখন একজন শিক্ষার্থী কোডিংয়ের মাধ্যমে একটি গাণিতিক মডেল তৈরি করে, একটি অ্যানিমেশন ডিজাইন করে অথবা একটি নতুন অ্যালগরিদম তৈরি করে, তখন তারা তাদের সৃজনশীলতার চূড়ান্ত প্রকাশ ঘটায়।
কোডিং শিক্ষার্থীদেরকে কেবল তৈরি করা জিনিস ব্যবহার করতে শেখায় না, বরং নতুন কিছু তৈরি করতে উৎসাহিত করে। তারা নিজের মতো করে সমস্যা সমাধান করতে পারে, নিজেদের উদ্ভাবনী ক্ষমতা ব্যবহার করে নতুন সমাধান খুঁজে বের করতে পারে। এটি গণিতকে একটি প্যাসিভ বিষয় থেকে একটি অ্যাক্টিভ এবং সৃজনশীল বিষয়ে রূপান্তরিত করে, যেখানে শিক্ষার্থীরা নিজেদের চিন্তাভাবনাকে বাস্তবায়িত করার সুযোগ পায়।
ভবিষ্যৎ কর্মজীবনের জন্য প্রস্তুতি: একবিংশ শতাব্দীর দক্ষতা
বর্তমানে এবং ভবিষ্যতে কর্মজীবনের জন্য কোডিং একটি অপরিহার্য দক্ষতা। কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা (AI), ডেটা সায়েন্স, মেশিন লার্নিং, রোবটিক্স – এই প্রতিটি ক্ষেত্রেই গণিত এবং কোডিংয়ের গভীর জ্ঞান প্রয়োজন। গণিতের ধারণাগুলো এই প্রযুক্তিগুলোর ভিত্তি তৈরি করে এবং কোডিং সেগুলোকে বাস্তবায়িত করার মাধ্যম হিসেবে কাজ করে।
গণিত শিক্ষায় কোডিং অন্তর্ভুক্ত করার মাধ্যমে শিক্ষার্থীদেরকে ভবিষ্যতের শ্রমবাজারের জন্য প্রস্তুত করা হচ্ছে। যারা গণিত এবং কোডিং উভয় ক্ষেত্রেই পারদর্শী হবে, তাদের জন্য কর্মজীবনের অনেক নতুন দুয়ার খুলে যাবে। এটি কেবল প্রযুক্তি খাতেই সীমাবদ্ধ নয়, অর্থনীতি, স্বাস্থ্যসেবা, বিজ্ঞান গবেষণা এবং এমনকি শিল্পকলাতেও কোডিংয়ের ব্যবহার বাড়ছে। তাই, গণিতের সাথে কোডিংয়ের সমন্বয় শিক্ষার্থীদেরকে একবিংশ শতাব্দীর চ্যালেঞ্জ মোকাবেলায় সক্ষম করে তুলবে।
গণিত শিক্ষায় কোডিংয়ের গুরুত্ব অপরিসীম হলেও, এর সফল বাস্তবায়নে কিছু চ্যালেঞ্জ রয়েছে। শিক্ষকদেরকে এই নতুন পদ্ধতির সাথে পরিচিত হতে হবে এবং নিজেদের কোডিং দক্ষতা বাড়াতে হবে। কোডিং শেখানোর জন্য প্রয়োজনীয় সফটওয়্যার এবং হার্ডওয়্যারের সরবরাহ নিশ্চিত করতে হবে। এছাড়াও, পাঠ্যক্রমকে এমনভাবে সাজাতে হবে যাতে গণিতের ধারণাগুলো কোডিংয়ের মাধ্যমে সহজে শেখানো যায়।
তবে এই চ্যালেঞ্জগুলো মোকাবেলার জন্য বিভিন্ন অনলাইন রিসোর্স, শিক্ষক প্রশিক্ষণ প্রোগ্রাম এবং শিক্ষামূলক প্ল্যাটফর্ম উপলব্ধ রয়েছে। সরকার এবং শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোকে এই ক্ষেত্রে বিনিয়োগ করতে হবে যাতে শিক্ষার্থীরা কোডিংয়ের মাধ্যমে গণিত শেখার সুযোগ পায়।
গণিত শিক্ষায় কোডিংয়ের সংযুক্তি একবিংশ শতাব্দীর শিক্ষাব্যবস্থার জন্য একটি গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপ। এটি কেবল শিক্ষার্থীদের গণিতের প্রতি আগ্রহ বাড়ায় না, বরং তাদের সমস্যা সমাধানের দক্ষতা, যৌক্তিক চিন্তাভাবনা, সৃজনশীলতা এবং বাস্তব জীবনের সাথে গণিতের সম্পর্ক বুঝতে সাহায্য করে। কোডিং গণিতের বিমূর্ত ধারণাগুলোকে মূর্ত করে তোলে, ভুল থেকে শেখার সুযোগ দেয় এবং শিক্ষার্থীদেরকে ভবিষ্যতের কর্মজীবনের জন্য প্রস্তুত করে।
গণিত এবং কোডিং একে অপরের পরিপূরক এবং এই দুইয়ের সমন্বয় শিক্ষার্থীদের একটি শক্তিশালী ভিত্তি তৈরি করে দেবে, যা তাদের কেবল একাডেমিক সাফল্যই নয়, বরং জীবনের প্রতিটি ক্ষেত্রে সাফল্যের দিকে নিয়ে যাবে। তাই, আমাদের শিক্ষা ব্যবস্থায় গণিত ও কোডিংয়ের সেতুবন্ধনকে আরও দৃঢ় করা উচিত, যাতে ভবিষ্যৎ প্রজন্ম একটি সুশিক্ষিত এবং প্রযুক্তিনির্ভর বিশ্বের জন্য প্রস্তুত হতে পারে।