
ডা.মুহাম্মাদ মাহতাব হোসাইন মাজেদ, লেখক, চিকিৎসক, কলাম লেখক ও গবেষক প্রতিষ্ঠাতা ও চেয়ারম্যান, জাতীয় রোগী কল্যাণ সোসাইটি : বিশ্ব আজ এক চরম স্বাস্থ্য সংকটের মধ্য দিয়ে অগ্রসর হচ্ছে।একদিকে মহামারির রূপ নেওয়া করোনা ভাইরাস, অন্যদিকে ঋতু পরিবর্তনের সঙ্গে সঙ্গে ডেঙ্গু ও চিকুনগুনিয়ার মতো মশাবাহিত রোগের প্রকোপ আমাদের জনস্বাস্থ্য ব্যবস্থাকে চ্যালেঞ্জের মুখে ফেলেছে। বাংলাদেশে ২০২৫ সালে এই তিনটি রোগ একযোগে জনমনে উদ্বেগ সৃষ্টি করছে। এই প্রবন্ধে করোনা, ডেঙ্গু ও চিকুনগুনিয়ার কারণ, সংক্রমণ প্রক্রিয়া, লক্ষণ, প্রতিকার এবং প্রতিরোধ নিয়ে বিশদ আলোচনা করব।
> করোনা ভাইরাস: কারণ ও সংক্রমণ
করোনা ভাইরাস (COVID-19) হলো এক ধরনের ভাইরাস, যা মূলত শ্বাসযন্ত্রকে আক্রান্ত করে। ২০১৯ সালে চীনের উহান শহর থেকে প্রথম শনাক্ত হওয়ার পর এটি বিশ্বব্যাপী ছড়িয়ে পড়ে। ২০২৫ সালে করোনার নতুন ভ্যারিয়েন্টগুলোর কারণে পুনরায় সংক্রমণ বৃদ্ধি পাচ্ছে।শুক্রবার (২৭ জুন২০২৫) চলতি বছর দেশে করোনায় মৃত্যু বেড়ে দাঁড়ালো ২০ জনে। এছাড়া ২৪ ঘণ্টায় ১০ জনের করোনা শনাক্ত হয়েছে।স্বাস্থ্য অধিদপ্তর জানায়, ২৪ ঘণ্টায় সারাদেশে ১৯৯ জনের করোনার নমুনা পরীক্ষা করে ১০ জনের মধ্যে করোনাভাইরাসের উপসর্গ পাওয়া যায়। এর মধ্যে আক্রান্ত একজনের মৃত্যু হয়েছে। ১ জানুয়ারি থেকে এ পর্যন্ত দেশে নমুনা পরীক্ষা করা হয়েছে ৭ হাজার ৫৫৫ জনের। এর মধ্যে ৫২৮ জনের মধ্যে করোনাভাইরাসের উপসর্গ পাওয়া গেছে। এই সময়ে মারা গেছেন ২০ জন।এদিকে করোনা মহামারির শুরু থেকে এ পর্যন্ত দেশে মোট ২০ লাখ ৫২ হাজার ৭৩ জনের করোনা শনাক্ত হয়েছে। এছাড়া দেশে করোনায় মোট মৃত্যু বেড়ে দাঁড়িয়েছে ২৯ হাজার ৫১৯ জনে
> করোনার কারণসমূহ:
নভেল করোনা ভাইরাস (SARS-CoV-2) নামক ভাইরাসটি সংক্রমণের মূল কারণ।
ভাইরাসটি মূলত আক্রান্ত ব্যক্তির হাঁচি-কাশি, কথা বলা বা শ্বাস-প্রশ্বাসের মাধ্যমে নিঃসৃত ড্রপলেট ও এরোসলের মাধ্যমে ছড়ায়।দূষিত বস্তু বা পৃষ্ঠ স্পর্শ করার পর মুখ, নাক বা চোখ স্পর্শ করলেও ভাইরাস সংক্রমণ হতে পারে।জনসমাগমপূর্ণ স্থান এবং স্বাস্থ্যবিধি উপেক্ষা সংক্রমণ বাড়ায়।
> ডেঙ্গু: কারণ ও সংক্রমণ
ডেঙ্গু হলো এক ধরনের ভাইরাসজনিত রোগ, যা মূলত এডিস ইজিপ্টাই এবং এডিস অ্যালবোপিক্টাস মশার কামড়ের মাধ্যমে ছড়ায়। প্রতি বছর বর্ষা মৌসুমে বাংলাদেশে ডেঙ্গুর প্রাদুর্ভাব দেখা যায়। ২০২৫ সালে আবহাওয়া পরিবর্তন এবং অপরিকল্পিত নগরায়নের কারণে ডেঙ্গু পরিস্থিতি আরও জটিল আকার নিচ্ছে।
শুক্রবার (২৭ জুন২০২৫ )চলতি বছর ডেঙ্গুতে মারা গেছেন ৪০ জন। গত ২৪ ঘণ্টায় ১৬৯ ডেঙ্গুরোগী হাসপাতাল থেকে ছাড়পত্র পেয়েছেন। এ নিয়ে চলতি বছরে ছাড়পত্র পেয়েছেন আট হাজার ১৬২ জন। আর চলতি বছর ডেঙ্গু আক্রান্তের সংখ্যা নয় হাজার ২২২ জন। তাদের মধ্যে ৫২ দশমিক ৬ শতাংশ পুরুষ এবং ৪৭ দশমিক ৪ শতাংশ নারী।২০২৩ সালে সারাদেশে ডেঙ্গুতে এক হাজার ৭০৫ জনের মৃত্যু ও আক্রান্ত হয়ে হাসপাতালে ভর্তি হন তিন লাখ ২১ হাজার ১৭৯ জন। গত বছর অর্থাৎ ২০২৪ সালে ডেঙ্গুতে মৃত্যু ৫৭৫ জনের এবং আক্রান্ত হয়ে হাসপাতালে ভর্তি হন এক লাখ এক হাজার ২১৪ জন।
> ডেঙ্গুর কারণসমূহ:
ডেঙ্গু ভাইরাস (DENV) চারটি প্রধান ধরন রয়েছে (DENV-1, 2, 3, 4)।মশার কামড়ের মাধ্যমে ভাইরাস রক্তে প্রবেশ করে।স্থির পানি, যেমন ফুলের টব, পরিত্যক্ত টায়ার, ড্রেন বা নির্মাণস্থলে পানি জমে থাকলে মশার বংশ বিস্তার হয়।নগরায়ন, বৃষ্টিপাত, জলাবদ্ধতা ডেঙ্গু সংক্রমণ বাড়ায়।
> চিকুনগুনিয়া: কারণ ও সংক্রমণ
চিকুনগুনিয়া ভাইরাসও মশাবাহিত রোগ। এটি প্রধানত এডিস মশা বহন করে থাকে এবং ডেঙ্গুর মতোই নগর এলাকায় বিস্তার ঘটে।এ বছর সারাদেশে এখন পর্যন্ত ৪৫ শতাংশ জ্বরের রোগীর চিকুনগুনিয়া শনাক্ত হয়েছে। এখন পর্যন্ত ৪৫০ জনের নমুনা পরীক্ষায় ১৫০ জনের চিকুনগুনিয়া শনাক্ত হয়েছে।
> চিকুনগুনিয়ার কারণসমূহ:
চিকুনগুনিয়া ভাইরাস মশার মাধ্যমে মানুষের রক্তে প্রবেশ করে।ডেঙ্গুর মতো চিকুনগুনিয়ার ক্ষেত্রেও মশার প্রজননক্ষেত্র হলো স্থির পানি।অপরিকল্পিত ড্রেনেজ, আবর্জনার স্তূপ এবং বৃষ্টির পানি জমে থাকা রোগ ছড়াতে সহায়ক হয়।
> করোনা, ডেঙ্গু ও চিকুনগুনিয়ার লক্ষণসমূহ
_ প্রধান লক্ষণ * করোনা জ্বর, শুকনো কাশি, শ্বাসকষ্ট, গলা ব্যথা, স্বাদ-গন্ধ হারানো, ক্লান্তি, * ডেঙ্গু উচ্চ জ্বর, চোখের পেছনে ব্যথা, ত্বকে ফুসকুড়ি, পেশি ও হাড়ের ব্যথা, রক্তক্ষরণ * চিকুনগুনিয়া হঠাৎ উচ্চ জ্বর, তীব্র জয়েন্ট ব্যথা, ত্বকে ফুসকুড়ি, মাথা ব্যথা
> করোনা ভাইরাসের প্রতিকার
* বিশ্রাম ও পুষ্টিকর খাবার: করোনায় আক্রান্ত ব্যক্তিকে পর্যাপ্ত বিশ্রাম ও তরল খাবার গ্রহণ করতে হবে।
* জরুরি চিকিৎসা: শ্বাসকষ্ট বা অক্সিজেন স্বল্পতা দেখা দিলে হাসপাতালে ভর্তি হতে হবে।
* ভ্যাকসিন: ২০২৫ সালে আপডেটেড ভ্যাকসিন নেয়া এবং বুস্টার ডোজ গ্রহণ করা জরুরি।
> ডেঙ্গুর প্রতিকার
* ডেঙ্গুর নির্দিষ্ট কোনো অ্যান্টিভাইরাল ওষুধ নেই। * হাইড্রেশন: পর্যাপ্ত পানি ও ইলেক্ট্রোলাইট গ্রহণ করতে হবে। * রক্তক্ষরণ: রক্তের প্লেটলেট অনেক কমে গেলে হাসপাতালে ভর্তি হয়ে রক্ত ও তরল গ্রহণ করতে হতে পারে।
> চিকুনগুনিয়ার প্রতিকার
* চিকুনগুনিয়ারও কোনো নির্দিষ্ট প্রতিষেধক নেই। * ব্যথানাশক ওষুধ: জয়েন্টের ব্যথা উপশমে ব্যবহার হয়। * বিশ্রাম: আক্রান্ত ব্যক্তিকে জয়েন্ট বিশ্রাম দিতে হবে। * হাইড্রেশন: শরীরে পানির ঘাটতি যেন না হয় সেদিকে খেয়াল রাখতে হবে।
> প্রতিরোধ ও জনসচেতনতা
_ করোনা প্রতিরোধ:- * নিয়মিত হাত ধোয়া।
* মাস্ক ব্যবহার করা। * ভিড় এড়িয়ে চলা।
* সঠিকভাবে ভ্যাকসিন গ্রহণ।
_ ডেঙ্গু প্রতিরোধ:-মশার প্রজননক্ষেত্র ধ্বংস করা (যেমন ফুলের টব, পরিত্যক্ত পাত্রে পানি জমতে না দেওয়া)।* ঘুমানোর সময় মশারি ব্যবহার। * পুরো হাত-পা ঢাকা কাপড় পরা।* মশার ওষুধ স্প্রে করা।
_ চিকুনগুনিয়া প্রতিরোধ :-ডেঙ্গুর মতোই চিকুনগুনিয়ার প্রতিরোধে মশা নিয়ন্ত্রণ জরুরি।
> জনসচেতনতা বৃদ্ধি করা।
* স্থানীয় প্রশাসনকে সঙ্গে নিয়ে মশা নিধনের কার্যক্রম পরিচালনা করা। * ২০২৫ সালের বাস্তবতা ও করণীয় * ২০২৫ সালে করোনা, ডেঙ্গু এবং চিকুনগুনিয়ার সংক্রমণ একযোগে বাড়ছে, যা জনস্বাস্থ্যের জন্য অশনিসঙ্কেত। এ সময় সরকারের পাশাপাশি জনগণেরও দায়িত্ব রয়েছে—* পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতা বজায় রাখা।* ভ্যাকসিন গ্রহণে সচেতন থাকা।* মহল্লা ভিত্তিক মশা নিধন কর্মসূচি জোরদার করা।
* গুজব ও ভুয়া চিকিৎসা পদ্ধতি থেকে দূরে থাকা।
পরিশেষে বলতে চাই, বর্ষায় এডিস মশার বিস্তার বেড়ে যাওয়ায়। করোনা, ডেঙ্গু ও চিকুনগুনিয়া—এ তিনটি রোগই আমাদের জনস্বাস্থ্যকে হুমকির মুখে ফেলেছে। এদের বিরুদ্ধে লড়াইয়ে প্রয়োজন সম্মিলিত প্রচেষ্টা, জনসচেতনতা, সময়োপযোগী চিকিৎসা ব্যবস্থা এবং সরকারি উদ্যোগের সমন্বয়। স্বাস্থ্যবিধি মানা, মশার প্রজননস্থল ধ্বংস করা এবং সময়মতো চিকিৎসা গ্রহণের মাধ্যমেই এই বিপর্যয় মোকাবিলা সম্ভব।