প্রিয় ক্যালিফোর্নিয়ার লাল মদ আর কিনছেন না টড ব্রেম্যান। কানাডার সশস্ত্র বাহিনীর সাবেক এই সদস্য এখন যুক্তরাষ্ট্রের পণ্য বর্জন করছেন। শুধু তিনিই নন—কানাডা, ইউরোপ ও বিশ্বের বিভিন্ন অঞ্চলে অনেকেই মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের শুল্ক নীতি ও মিত্রদের প্রতি তার আচরণের প্রতিবাদে একই সিদ্ধান্ত নিচ্ছেন।

নোভা স্কোশিয়ার বাসিন্দা ব্রেম্যান বলেন, “আমার জীবনে আমি আমেরিকান বাহিনীর সঙ্গে কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে কাজ করেছি। আমাদের দুই দেশের ঐতিহাসিক সম্পর্ক বিবেচনায় এটা খুবই কষ্টদায়ক ও হতাশাজনক। তবে এখন সময় এসেছে অবস্থান নেওয়ার। আমি মনে করি, স্থানীয় পণ্য কিনে কানাডিয়ান ব্যবসাকে সমর্থন করা উচিত।”
তার স্ত্রীকে সঙ্গে নিয়ে ব্রেম্যান তাদের সব মার্কিন পণ্যের বিকল্প খুঁজে নিয়েছেন। তার আগের প্রিয় আমেরিকান রেড ওয়াইনের জায়গায় এখন স্থান পেয়েছে নোভা স্কোশিয়ারই ‘লাকেট ফোন বক্স রেড’। তবে কানাডিয়ান পণ্য চেনাও সবসময় সহজ নয়। “অনেক সময় পণ্যের লেবেল বিভ্রান্তিকর,” বললেন তিনি।
তাই এখন তিনি ব্যবহার করেন একটি মোবাইল অ্যাপ—‘ম্যাপল স্ক্যান’। বারকোড স্ক্যান করে পণ্যের উৎস চিহ্নিত করে এই অ্যাপটি, আর যদি তা আমেরিকান হয়, তাহলে কানাডিয়ান বিকল্পও দেখায়। অ্যাপটি ইতিমধ্যে এক লাখের বেশি ডাউনলোড হয়েছে।
অ্যাপটির নির্মাতা সাশা ইভানভ বলেন, “অনেকেই বলছেন, ‘আমি আর ফিরে যাচ্ছি না’। স্থানীয় পণ্যের প্রতি সমর্থন সময়োপযোগী ও প্রয়োজনীয়।”
ট্রাম্পের শুল্ক নীতির প্রতিক্রিয়ায় কানাডার পাল্টা ব্যবস্থা
ট্রাম্প প্রশাসন আমদানিকৃত গাড়ি, স্টিল ও অ্যালুমিনিয়ামে ২৫% শুল্ক এবং অন্যান্য কানাডিয়ান ও মেক্সিকান পণ্যে অতিরিক্ত শুল্ক আরোপ করেছে। ইউরোপীয় ইউনিয়নের রপ্তানির ওপর ২০% ও যুক্তরাজ্যের পণ্যে ১০% হারে শুল্ক আরোপ করা হয়েছে।
ট্রাম্প বলেন, এসব শুল্কে যুক্তরাষ্ট্রের উৎপাদন খাত উপকৃত হবে, রাজস্ব বাড়বে এবং বাণিজ্য ঘাটতি কমবে। তবে বৈশ্বিক বাজারে এতে অস্থিরতা দেখা দিয়েছে।
ট্রাম্প তো কানাডাকে যুক্তরাষ্ট্রের ৫১তম রাজ্য বানানোরও প্রস্তাব দিয়েছেন! বিষয়টি তীব্রভাবে প্রত্যাখ্যান করেছে কানাডা। পাল্টা ব্যবস্থা হিসেবে কানাডা ৬০ বিলিয়ন ডলারের প্রতিশোধমূলক শুল্ক আরোপ করেছে, যার মধ্যে রয়েছে যুক্তরাষ্ট্রের অটো খাতও।
ফলে অনেক কানাডিয়ান যুক্তরাষ্ট্র সফরও কমিয়ে দিয়েছেন।
ইউরোপেও ছড়াচ্ছে মার্কিন পণ্য বর্জনের বার্তা
ডেনমার্কেও বয়কট আন্দোলন তীব্র হচ্ছে। গ্রিনল্যান্ড কিনতে চাওয়ার ট্রাম্পের মন্তব্যে ডেনিশদের ক্ষোভ আরও বেড়েছে। দেশটির বৃহত্তম খুচরা বিক্রেতা ‘সালিং গ্রুপ’ ইউরোপিয়ান ব্র্যান্ড চিহ্নিত করতে কালো তারা চিহ্ন যুক্ত করছে।
কোপেনহেগেনের কাছে স্কোভলুন্ডে বসবাসকারী স্কুলপ্রধান বো আলবার্টাস বলেন, “আমি আমেরিকার রাজনীতিতে কিছু করতে পারি না, কিন্তু আমার ক্রেডিট কার্ড দিয়েই ভোট দিতে পারি।” তিনি এখন আর নেটফ্লিক্স, ডিজনি প্লাস বা অ্যাপল টিভির মতো মার্কিন স্ট্রিমিং সেবা ব্যবহার করেন না।
তিনি যে ফেসবুক গ্রুপটি পরিচালনা করেন, তাতে ৯০ হাজার সদস্য নিয়মিত আমেরিকান পণ্যের বিকল্প খুঁজে শেয়ার করছেন। “এটা শুধু ডেনমার্ক নয়, অনেক বড় একটা বৈশ্বিক আন্দোলনে পরিণত হচ্ছে,” বলেন তিনি।
দোকানিদের ভূমিকাও গুরুত্বপূর্ণ
কোপেনহেগেনের মুদি দোকান ‘ব্রডারস’-এর মালিক মেট হেরুলফ ক্রিশ্চিয়ানসেন তার দোকান থেকে আমেরিকান পণ্য, যেমন চিটোস বা হার্শিস, বাদ দিয়েছেন। বিকল্প হিসেবে ইউরোপিয়ান পণ্যই রাখছেন।
“কোকা-কোলার পরিবর্তে ড্যানিশ ব্র্যান্ড জলি কোলা সহজেই পাওয়া যায়,” বলেন তিনি। তবে ফেসবুকের মতো প্রযুক্তি থেকে দূরে থাকা কঠিন।
তার মতে, ডেনিশদের অনেকের কাছে এটা মানসিক প্রশান্তির বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে—“ট্রাম্পের নীতির বিরুদ্ধে কিছু একটা করার অনুভূতি।”
বিশ্লেষকরা কী বলছেন?
ডার্টমাউথ কলেজের অর্থনীতির অধ্যাপক ডগলাস আর্ভিন মনে করেন, এই বয়কটের অর্থনৈতিক প্রভাব সীমিত হতে পারে। “ইতিহাসে দেখা গেছে, এমন বয়কট খুব বেশি দিন স্থায়ী হয় না এবং কার্যকরতাও সীমিত।”
তবুও এখনই কানাডিয়ান পণ্যের চাহিদা বেড়েছে। কানাডার বড় মুদি প্রতিষ্ঠান ‘লবলো’-এর সিইও জানিয়েছেন, স্থানীয় পণ্যের সাপ্তাহিক বিক্রি দ্বিগুণ হারে বেড়েছে।
উত্তর আমেরিকার সীমান্তে ব্যবসার চাপ
ভ্যারমন্টের ক্যালেডোনিয়া স্পিরিটস ডিস্টিলারির প্রেসিডেন্ট রায়ান ক্রিশ্চিয়ানসেন বলেন, “আমরা কুইবেকে পাঠাতে চাওয়া এক চালান শেষ মুহূর্তে বাতিল করতে বাধ্য হই।” তিনি আরও বলেন, “আমি চাই সবাই মিলে বসে শান্তিপূর্ণ সমাধানে পৌঁছাক।”
নিউইয়র্কভিত্তিক মসলা কোম্পানি ‘বারল্যাপ অ্যান্ড ব্যারেল’-এর সহপ্রতিষ্ঠাতা ইথান ফ্রিশ বলেন, “বয়কটের মাধ্যমে মার্কিন অর্থনীতির উপর প্রভাব ফেলতে পারা বাস্তবে ততটা কার্যকর নয়। মার্কিন অর্থনীতি এমনিতেই সংকটে।”
“বয়কট ছাড়াই আমরা সংকটে আছি,” যোগ করেন তিনি।