সাবিত রিজওয়ান
নদের তীরে এসে দেখি—জলের চেয়ে আবর্জনাই বেশি। কোথাও টলটলে জল নেই, আছে শুধু নোংরা গন্ধ আর নষ্ট জীবনের ছাপ। দূরগন্ধ ভেসে বেড়াচ্ছে বাতাসে, মশারা গান গেয়ে গেয়ে মাথা খাচ্ছে! মনে হচ্ছে আমি কোনো যুদ্ধের ময়দানে, ট্যাঙ্কের মুখোমুখি দাঁড়িয়ে আছি।
না, এখানে আর এক মুহূর্তও থাকা যাবে না। পালাতে হবে—নইলে দেহে জ্বর উঁকি দেবে।
সন্নিহিত কে-জি স্কুলটার সামনে গিয়ে দেখি—কয়েকজন অদ্ভুতদর্শন মানুষ নয়, কী যেন! যেন ভয়ংকর প্রাণী।
তারা এক মৃতদেহকে কাবাব বানিয়ে খেতে ব্যস্ত। খাচ্ছে, হাগছে, থু থু দিচ্ছে—সব একসাথে।
তারা একটি তরল পদার্থ পান করছে, যার গন্ধ প্রস্রাবের মতো।
তাদের মাথায় যেমন চুলের কাটিং, যেন চুল নয়, সাপের গুচ্ছ।
চোখের রঙ প্রকৃত নয়—চোখের মাঝে অর্থাৎ চোখের তাঁরাও বিকৃত। এগুলো কি শিল্প? কারো কারো ভ্রু, পাতায় আঁকা বিভিন্ন প্রতিচ্ছবি, যেমন— মোটরসাইকেল, সিগারেট, রংধনু, জীবজন্তু ইত্যাদি। কারো চোখে চশমা, লেন্স দেখলাম, তারা অন্ধ নাকি? মনের মাঝে বলক উঠলো, তারা কী সুশীল?
কারো সারা গায়ে অদ্ভুত আর্ট—
বুকজুড়ে অর্ধেক মানুষ, অর্ধেক পাখির অবয়ব, পিঠে খোলা মুখ—জিভ বেরিয়ে আছে। কারো সারা গায়ে চোখ আঁকা, যেন সর্বদ্রষ্টা।
কারো হাতে হাতি, পায়ে শয়ূর, পিঠে পেঁচা! দেখলাম একজনের চেহারায় গলা কাটার প্রতিচ্ছবি, দেখে মনে হবে বাস্তবে তার গলা কাটা। কারো জিভে বিচ্ছুর প্রতিচ্ছবি, বা প্রাণীটির মতো আকৃতি। কারো নাক চেরা, কারো নাকে ঈগলের প্রতিচ্ছবি। কারো কান নেই, কারো কান গাজরের মতো লম্বা, কারো কানে পেঁচার প্রতিচ্ছবি ইত্যাদি।
এসব কী? ফ্যাশন না বিকৃতি?
কারো দেহের অঙ্গ একটির সঙ্গে আরেকটির মিল নেই—ভঙ্গুর, বিকৃত, ভয়ের।
শুনেছি একসময় এই নদে জাহাজ চলত।
এখন নদে দুই-তৃতীয়াংশ জল শুকিয়ে বালুচর হয়ে গেছে। কোথাও কোনো মানুষের ছায়া নেই।
আমি পাশের বটগাছের দিক দিয়ে গ্রামের উদ্দেশে রওনা হলাম।
বটগাছটার নিচে বসে আছে এক ফণা তোলা সাপ। আমার দিকে ফোঁস ফোঁস করে তাকিয়ে আছে।
মনে হয়, সে ইশারায় বলতে চাইছে—
“তোর পায়ে ব্যথা, আয় (এসো), মালিশ করে দিই।”
উহ্! গাছ থেকে পুঁজের মতো কিছু ঝরছে।
বামপাশের রাস্তা দিয়ে ঘুরে যেতে হবে। সেখানে একটা গ্রাম আছে,
সেখান দিয়ে আমাদের গ্রামে যাব হয়তো ফিরতে দেরি হবে,
তবুও কী আর করার আছে?
সূর্যি মামা যেন লুকোচুরি খেলছে, আবছা আলো।
এমন সময় হঠাৎ আবির্ভাব হয় বিশাল এক দৈত্যের।
সে বারবার পিষে ফেলতে চায় আমাকে—
আমি তার পায়ের নিচে গড়াগড়ি খাচ্ছি!
মনে পড়ে গেল শাহজালালের সেই কথা—
“মশার চাইতে মানুষই বেশি বংশবিস্তার করে।”
কিন্তু এই শহরে কি দৈত্যরাই বেশি বংশবিস্তার করছে?
ওরা, যারা মৃতদেহ খাচ্ছিল, এবার আমার সামনে এসে হাজির।
তারা আমাকেই খেতে চায়!
সবাই বুঝি দৈত্য কমিটিতে নিযুক্ত।
তাদের কণ্ঠে ভেসে আসে এক কুৎসিত ঘোষণা—“যে আমাদের ফ্রেন্ডসের কাজে বিঘ্ন ঘটায়, তাকে আমরা বাঁচতে দেব না!”
কারা তাদের ফ্রেন্ডস? আমি কোন কাজে, কবে বিঘ্ন ঘটালাম? তারা আমার বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করল নাকি?
আমি পালাতে চাই, কিন্তু শরীর যেন পাথর হয়ে গেছে।
পাহাড়ের মতো ভারী লাগছে নিজেরই দেহ।
হঠাৎ কোথা থেকে আমার দিকে ঢিল ছোঁড়া শুরু হয়।
একটা ঢিল এসে মুখে লাগে—
একটা দাঁত পড়ে যায়!
প্রচণ্ড ব্যথা।
মাথাটা ঝিমিয়ে আসে, চারপাশকে ঘোলাটে মনে হয়। শরীরটা হেলে পড়ে, অনুভব হয় পায়ের নিচের মাটিগুলো সরে যাচ্ছে কিন্তু আমি নড়তে পারছিনা। চোখের পল্লব দুটো ধীরে ধীরে নেমে আসে।
• কে যেন কানের কাছে এসে অনবরত ডাকছে—”তুফান, সবাই যদি হাল ছাড়তে বসে তাহলে সমাজকে দূরাবস্থা থেকে মুক্ত করবে কে? এই অসচেতন সমাজ থেকে ভ্রষ্টতা-অবিচারের বিরুদ্ধে কে দাঁড়াবে? কে গড়ে তুলবে সমাজে ঐক্যতা? মানুষ প্রযুক্তিতে এতটাই আসক্ত যে, নিজের চেতনাটাকে জাগিয়ে তুলতে পারে না।”
আমরা স্বাভাবিক ভাবে কতখানি জীবন-যাপন করি? মানুষ তার মনুষ্যত্ব ভুলে যাচ্ছে,…বা হয়তো মানুষ আর মানুষ নেই।