সাদিয়া সুলতানা রিমি : জলবায়ু পরিবর্তন, একবিংশ শতাব্দীর অন্যতম প্রধান বৈশ্বিক চ্যালেঞ্জ। এর প্রভাব সুদূরপ্রসারী, যা পৃথিবীর প্রাকৃতিক পরিবেশ থেকে শুরু করে মানব সভ্যতা পর্যন্ত সবকিছুকে প্রভাবিত করছে। এই জটিল ঘটনাকে অনুধাবন, ভবিষ্যদ্বাণী এবং এর সম্ভাব্য সমাধান খুঁজতে বিজ্ঞানীরা বিভিন্ন মডেলের ওপর নির্ভর করেন। আর এই মডেলগুলোর মেরুদণ্ড হলো গণিত। গণিত ছাড়া জলবায়ু মডেলিং অসম্ভব, কারণ এটি প্রাকৃতিক প্রক্রিয়াগুলোকে পরিমাণগতভাবে বর্ণনা করতে, ডেটা বিশ্লেষণ করতে এবং ভবিষ্যতের গতিপথ অনুমান করতে অপরিহার্য একটি হাতিয়ার।
জলবায়ু মডেল হলো পৃথিবীর জলবায়ু ব্যবস্থার বিভিন্ন উপাদান যেমন বায়ুমণ্ডল, মহাসাগর, ভূমি পৃষ্ঠ এবং বরফ আচ্ছাদনের মধ্যেকার মিথস্ক্রিয়া অনুকরণ করার জন্য তৈরি গাণিতিক সমীকরণের একটি সেট। এই মডেলগুলো পদার্থবিজ্ঞানের মৌলিক সূত্র, যেমন তাপগতিবিদ্যা, তরল গতিবিদ্যা এবং বিকিরণ স্থানান্তরের ওপর ভিত্তি করে তৈরি। সহজ কথায়, জলবায়ু মডেল হলো পৃথিবীর জলবায়ু কীভাবে কাজ করে তার একটি গাণিতিক প্রতিরূপ। এর মাধ্যমে বিজ্ঞানীরা অতীত জলবায়ু পরিস্থিতি পুনর্গঠন করতে পারেন, বর্তমান পরিবর্তনগুলো ব্যাখ্যা করতে পারেন এবং ভবিষ্যতের জলবায়ু কেমন হতে পারে তা অনুমান করতে পারেন।
জলবায়ু মডেলিংয়ে গণিতের ব্যবহার বহুবিধ এবং অপরিহার্য। এর মূল ভিত্তি হলো আংশিক অন্তরক সমীকরণ (Partial Differential Equations – PDEs)। এই সমীকরণগুলো বায়ুমণ্ডল ও মহাসাগরে তাপ, আর্দ্রতা, চাপ এবং গতির পরিবর্তন বর্ণনা করে। উদাহরণস্বরূপ, বায়ুমণ্ডলে বাতাসের গতিবিধি, তাপমাত্রা এবং আর্দ্রতার বিস্তারকে বর্ণনা করতে যে সমীকরণগুলো ব্যবহার করা হয়, সেগুলো সবই PDE-এর অন্তর্গত। নিউটনের গতির সূত্র, ভর সংরক্ষণ সূত্র, শক্তি সংরক্ষণ সূত্র—এই মৌলিক পদার্থবিজ্ঞানের সূত্রগুলোই PDEs-এর মাধ্যমে জলবায়ু মডেলে প্রয়োগ করা হয়।
ন্যাভিয়ার-স্টোকস সমীকরণ (Navier-Stokes Equations): এই সমীকরণগুলো তরল পদার্থের গতিবিধি বর্ণনা করে, যা বায়ুমণ্ডল ও মহাসাগরের প্রবাহ মডেল করার জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। এগুলো বাতাসের গতি, সমুদ্র স্রোত এবং প্যাটার্নের পরিবর্তনশীলতা বুঝতে সাহায্য করে।
তাপগতিবিদ্যার সমীকরণ (Thermodynamic Equations): এগুলো তাপ স্থানান্তর এবং শক্তির রূপান্তর বর্ণনা করে। বায়ুমণ্ডলে এবং মহাসাগরে তাপমাত্রা এবং আর্দ্রতার পরিবর্তন কীভাবে ঘটে, তা বুঝতে এই সমীকরণগুলো অপরিহার্য।
বিকিরণ স্থানান্তরের সমীকরণ (Radiative Transfer Equations): এই সমীকরণগুলো সৌর বিকিরণ এবং পৃথিবীর তাপ বিকিরণ কীভাবে বায়ুমণ্ডল দ্বারা শোষিত, প্রতিফলিত বা নির্গত হয় তা বর্ণনা করে। গ্রিনহাউস প্রভাব এবং পৃথিবীর শক্তির ভারসাম্য বোঝার জন্য এগুলো অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।
ভর সংরক্ষণ সমীকরণ (Continuity Equation): এই সমীকরণটি বায়ুমণ্ডল এবং মহাসাগরে বাতাসের ভর এবং জলের ভরের পরিবর্তনশীলতা নিয়ন্ত্রণ করে।
এই সমীকরণগুলো অত্যন্ত জটিল এবং হাতে কলমে সমাধান করা প্রায় অসম্ভব। তাই বিজ্ঞানীরা সংখ্যাসূচক পদ্ধতি (Numerical Methods) ব্যবহার করেন। এই পদ্ধতিগুলো ব্যবহার করে ধারাবাহিক সমীকরণগুলোকে বিচ্ছিন্ন বিন্দুতে আনুমানিক মান দিয়ে প্রতিস্থাপন করা হয়, যা কম্পিউটার প্রোগ্রামিংয়ের মাধ্যমে সমাধান করা সম্ভব হয়। ফাইনাট ডিফারেন্স (Finite Difference), ফাইনাট এলিমেন্ট (Finite Element) এবং স্পেকট্রাল পদ্ধতি (Spectral Methods) এর মতো সংখ্যাসূচক পদ্ধতিগুলো ব্যবহার করে পৃথিবীর জলবায়ু ব্যবস্থাকে ছোট ছোট গ্রিড সেলে ভাগ করা হয় এবং প্রতিটি সেলের জন্য সমীকরণগুলো সমাধান করা হয়। এই গ্রিড সেলগুলো যত ছোট হয়, মডেলের রেজোলিউশন তত বেশি হয় এবং ফলাফল তত নির্ভুল হয়।
গণিত শুধু সমীকরণ সমাধানের মধ্যেই সীমাবদ্ধ নয়, এটি জলবায়ু ডেটা বিশ্লেষণ এবং ব্যাখ্যা করার ক্ষেত্রেও গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। তাপমাত্রা, বৃষ্টিপাত, সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা, কার্বন ডাই অক্সাইডের ঘনত্ব—এই বিশাল পরিমাণ ডেটা সংগ্রহ করা হয় এবং পরিসংখ্যানগত পদ্ধতি ব্যবহার করে সেগুলোকে বিশ্লেষণ করা হয়।
পরিসংখ্যানগত মডেলিং (Statistical Modeling): ঐতিহাসিক ডেটা থেকে প্রবণতা (trends) শনাক্ত করতে এবং ভবিষ্যতের পরিবর্তন অনুমান করতে পরিসংখ্যানগত মডেল ব্যবহার করা হয়। উদাহরণস্বরূপ, গত ১০০ বছরে বৈশ্বিক গড় তাপমাত্রা বৃদ্ধির প্রবণতা বিশ্লেষণ করতে রেগ্রেশন অ্যানালাইসিস (Regression Analysis) ব্যবহার করা হয়।
ত্রুটি বিশ্লেষণ (Uncertainty Analysis): জলবায়ু মডেলগুলোর পূর্বাভাসে সবসময় কিছু অনিশ্চয়তা থাকে। এই অনিশ্চয়তা পরিমাপ করতে এবং এর উৎসগুলো চিহ্নিত করতে পরিসংখ্যানগত পদ্ধতি, যেমন মন্টে কার্লো সিমুলেশন (Monte Carlo Simulations) ব্যবহার করা হয়। এই অনিশ্চয়তা বিভিন্ন কারণে হতে পারে, যেমন প্রাথমিক অবস্থার ডেটার অভাব, মডেলের সরলীকরণ বা ভবিষ্যৎ নির্গমনের পথ নিয়ে অনিশ্চয়তা।
মডেল যাচাইকরণ (Model Validation): মডেলের পূর্বাভাস ঐতিহাসিক পর্যবেক্ষণের সাথে কতটা মিলে যায় তা যাচাই করতে পরিসংখ্যানগত কৌশল ব্যবহার করা হয়। এটি মডেলের কার্যকারিতা এবং নির্ভরযোগ্যতা মূল্যায়নে সহায়তা করে।
উচ্চ কার্যকারিতা সম্পন্ন কম্পিউটিং (High-Performance Computing – HPC)
জলবায়ু মডেলের বিশাল পরিমাণ গাণিতিক গণনা সম্পন্ন করার জন্য উচ্চ কার্যকারিতা সম্পন্ন কম্পিউটারের প্রয়োজন হয়। বিশ্বের অন্যতম শক্তিশালী সুপারকম্পিউটারগুলো জলবায়ু গবেষণা এবং মডেলিংয়ের জন্য ব্যবহৃত হয়। এই কম্পিউটারগুলো হাজার হাজার সমীকরণকে সমান্তরালভাবে সমাধান করতে সক্ষম, যা কয়েক দশক বা শতকের জলবায়ু বিবর্তনকে কয়েক দিনে বা সপ্তাহে অনুকরণ করতে সাহায্য করে।
জলবায়ু মডেলগুলো তাদের জটিলতা এবং অন্তর্ভুক্ত প্রক্রিয়াগুলির উপর ভিত্তি করে বিভিন্ন ধরনের হতে পারে:
সাধারণ সার্কুলেশন মডেল (General Circulation Models – GCMs) / পৃথিবী সিস্টেম মডেল (Earth System Models – ESMs): এগুলো সবচেয়ে জটিল এবং ব্যাপক মডেল। GCMs বায়ুমণ্ডল এবং মহাসাগরের সাধারণ সঞ্চালন প্রক্রিয়াগুলো অনুকরণ করে। ESMs আরও এক ধাপ এগিয়ে বায়ুমণ্ডল, মহাসাগর, ভূমি, বরফ এবং জীবমণ্ডল সহ পৃথিবীর সমস্ত প্রধান উপাদান এবং তাদের মিথস্ক্রিয়াকে অন্তর্ভুক্ত করে। এই মডেলগুলো কার্বন চক্র, মিথেন চক্র এবং অন্যান্য জৈব-ভূ-রাসায়নিক প্রক্রিয়াগুলোও বিবেচনা করে।
আঞ্চলিক জলবায়ু মডেল (Regional Climate Models – RCMs): GCMs-এর তুলনায় RCMs একটি ছোট ভৌগোলিক এলাকার জন্য উচ্চতর রেজোলিউশনে বিস্তারিত জলবায়ু পরিবর্তন অনুকরণ করতে ব্যবহৃত হয়। এগুলো স্থানীয় প্রভাব যেমন পর্বত বা উপকূলীয় অঞ্চলের জলবায়ু পরিবর্তনকে আরও সঠিকভাবে উপস্থাপন করতে পারে।
সাধারণ জলবায়ু মডেল (Simple Climate Models): এগুলো তুলনামূলকভাবে সহজ এবং দ্রুত গণনাযোগ্য মডেল, যা নির্দিষ্ট জলবায়ু প্রতিক্রিয়া বা নীতি বিশ্লেষণের জন্য ব্যবহৃত হয়। উদাহরণস্বরূপ, কার্বন ডাই অক্সাইডের ঘনত্ব বৃদ্ধির সাথে বিশ্ব গড় তাপমাত্রার প্রতিক্রিয়া অনুমান করার জন্য এই মডেলগুলো ব্যবহার করা হয়।
জলবায়ু মডেলিংয়ের চ্যালেঞ্জ এবং গণিতের ভূমিকা
জলবায়ু মডেলিংয়ে বেশ কিছু চ্যালেঞ্জ বিদ্যমান, যার সমাধানে গণিতের ভূমিকা অনস্বীকার্য:
অনির্দিষ্টতা (Uncertainty): যেমনটি পূর্বে উল্লেখ করা হয়েছে, মডেলের পূর্বাভাসে অনিশ্চয়তা থাকে। গণিত ব্যবহার করে এই অনিশ্চয়তার মাত্রা পরিমাপ করা যায় এবং এর উৎসগুলো চিহ্নিত করা যায়, যা বিজ্ঞানীদের আরও নির্ভরযোগ্য পূর্বাভাস দিতে সাহায্য করে।
স্কেলিং সমস্যা (Scaling Problem): পৃথিবীর জলবায়ু ব্যবস্থায় অত্যন্ত ক্ষুদ্র মাপের প্রক্রিয়া (যেমন মেঘ গঠন) এবং অত্যন্ত বৃহৎ মাপের প্রক্রিয়া (যেমন মহাসাগরীয় স্রোত) উভয়ই বিদ্যমান। এই ভিন্ন ভিন্ন মাপের প্রক্রিয়াগুলোকে একটি একক মডেলে সঠিকভাবে উপস্থাপন করা একটি বড় চ্যালেঞ্জ। এখানে গাণিতিক পদ্ধতি, যেমন প্যারামিটারাইজেশন (Parameterization) ব্যবহার করা হয়, যেখানে ক্ষুদ্র মাপের প্রক্রিয়াগুলোকে বৃহৎ মাপের গ্রিড সেলে আনুমানিক মান দিয়ে উপস্থাপন করা হয়।
কম্পিউটেশনাল সীমাবদ্ধতা (Computational Limitations): আরও বাস্তবসম্মত এবং উচ্চ রেজোলিউশনের মডেল তৈরি করার জন্য আরও বেশি কম্পিউটেশনাল শক্তির প্রয়োজন। সমান্তরাল কম্পিউটিং (Parallel Computing) এবং নিউমেরিক্যাল অপটিমাইজেশন (Numerical Optimization) এর মতো গাণিতিক কৌশলগুলো কম্পিউটেশনাল দক্ষতা বাড়াতে সাহায্য করে।
ডেটা অভাব (Data Scarcity): কিছু অঞ্চলে বা নির্দিষ্ট ঐতিহাসিক সময়ের জন্য পর্যাপ্ত ডেটার অভাব থাকতে পারে। গাণিতিক ডেটা ইনপুটেশন (Data Imputation) এবং ডেটা অ্যাসিমিলিয়েশন (Data Assimilation) পদ্ধতি ব্যবহার করে এই অভাব মোকাবেলা করা যায়।
জলবায়ু পরিবর্তন একটি বহুমুখী সমস্যা, যার সমাধান কেবল বৈজ্ঞানিক গবেষণার মাধ্যমেই সম্ভব। আর এই গবেষণার কেন্দ্রবিন্দুতে রয়েছে গণিত। গণিত ছাড়া জলবায়ু মডেলিং অকল্পনীয়। এটি শুধু প্রাকৃতিক প্রক্রিয়াগুলোকে বর্ণনা করার একটি ভাষা নয়, বরং ডেটা বিশ্লেষণ, পূর্বাভাস তৈরি এবং ভবিষ্যতের সম্ভাব্য পরিস্থিতি অনুমানের একটি অপরিহার্য হাতিয়ার। জলবায়ু পরিবর্তনের চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায়, গাণিতিক মডেলিংয়ের অগ্রগতি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করবে। আরও নির্ভুল মডেল এবং উন্নত পূর্বাভাসের মাধ্যমে আমরা জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাবগুলি আরও ভালোভাবে বুঝতে পারব এবং এর মোকাবিলায় কার্যকর কৌশল তৈরি করতে সক্ষম হব। গণিত কেবল বিজ্ঞানীদের একটি সরঞ্জাম নয়, এটি জলবায়ু পরিবর্তনের বিরুদ্ধে আমাদের সবচেয়ে শক্তিশালী মিত্রদের মধ্যে একটি।
সাদিয়া সুলতানা রিমি
শিক্ষার্থী, গণিত বিভাগ
জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়