Site icon আজকের কাগজ

কোরবানি: ইসলামে আত্মত্যাগের এক অনন্য শিক্ষা

কোরবানি

মোঃ জামাল হোসেন (শিক্ষা কার্যক্রম পরিচালক, ন্যাশনাল গার্লস মাদরাসা, ফেনী)

পবিত্র ঈদুল আযহা মুসলিম উম্মাহর জন্য ত্যাগ, সহানুভূতি এবং আল্লাহর সন্তুষ্টি অর্জনের মহান উপলক্ষ। ইসলামের ভাষায় এ উৎসবের মূল আকর্ষণ ‘কোরবানি’ বা পশু উৎসর্গ যা ইব্রাহীম (আ.) এর সুন্নাহ। কোরবানি শব্দের অর্থই হলো “আল্লাহর নৈকট্য লাভের জন্য উৎসর্গ করা।” তবে কেবল পশু জবাই নয়—এর গভীরে লুকিয়ে আছে আত্মশুদ্ধি, ইখলাস (নিয়তের বিশুদ্ধতা) এবং সমাজের প্রতি দায়িত্ববোধ।

কোরবানির ইতিহাস শুরু নবী ইব্রাহিম (আ.) ও তাঁর পুত্র ইসমাঈল (আ.)-এর মাধ্যমে। আল্লাহর আদেশে ইব্রাহিম (আ.) নিজের প্রিয় পুত্রকে কোরবানি করতে প্রস্তুত হয়েছিলেন। আল্লাহ তাঁর এই নিষ্ঠা, আনুগত্য ও আত্মত্যাগ দেখে সন্তুষ্ট হন এবং ইসমাঈলের পরিবর্তে জান্নাতি দুম্বা পাঠিয়ে দেন।

কোরআনের আল্লাহ্‌ বলছেন, “অবশেষে যখন সে (ইসমাঈল) তার পিতার সঙ্গে চলাফেরা করার বয়সে পৌঁছালো, তখন সে বলল, হে আমার বৎস! আমি স্বপ্নে দেখি যে, আমি তোমাকে জবাই করছি। তোমার মতামত কী? সে বলল, হে আমার পিতা! আপনি যা আদিষ্ট হয়েছেন, তা করুন। ইনশাআল্লাহ, আপনি আমাকে ধৈর্যশীলদের অন্তর্ভুক্ত পাবেন।”
সূরা আস-সাফফাত, আয়াত ১০২

“তোমরা তোমাদের প্রতিপালকের জন্য নামাজ কায়েম কর এবং কোরবানি কর।”
সূরা আল-কাওসার, আয়াত

কোরবানি ফরজ নয়, তবে পৃথিবীর বেশির ভাগ আলেমের মতে এটি অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ সুন্নাত। আবার হানাফি মাজহাব অনুযায়ী এটি ‘সুন্নাতে মুয়াক্কাদা’। রাসুল (সা.) তাঁর জীবদ্দশায় কখনও কোরবানি বাদ দেননি।  

রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেছেন:

“যার সামর্থ্য থাকা সত্ত্বেও সে কোরবানি করে না, সে যেন আমাদের ঈদগাহে না আসে।”
(সুনান ইবনে মাজাহ, হাদিস: ৩১২৩)

ফিকহ অনুযায়ী, নিম্নোক্ত শর্তগুলো পূরণকারী মুসলমানদের উপর কোরবানি ওয়াজিব:

“প্রতিটি পরিবারে প্রতি বছর একটি করে কোরবানি যথেষ্ট।”
(তিরমিযি, হাদিস: ১৫০৫)

ইসলামে পশু কোরবানি করার জন্য হাদিস থেকে আমরা যে সকল প্রাণীর নাম জানতে পারি যেমন-

যে সকল পশু কোরবানি করা হবে তা অবশ্যই সুস্থ, বলিষ্ঠ ও নির্দিষ্ট বয়স পূর্ণ হওয়া চাই।

আল্লাহর কাছে পশুর গোশত বা রক্ত নয়, পৌঁছে আপনার নিয়ত তাকওয়া

“আল্লাহর কাছে তাদের গোশত ও রক্ত পৌঁছে না; বরং পৌঁছে তাদের তাকওয়া।”
সূরা আল-হাজ্জ, আয়াত ৩৭

রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেন:

“কাজ (আমল)-এর পুরস্কার নিয়তের উপর নির্ভরশীল।”
(সহিহ বুখারি, হাদিস: ১)

ইসলামী শরিয়ত অনুযায়ী কোরবানির মাংস তিনভাগে ভাগ করা উত্তম। তিনভাগে ভাগ করতেই হবে এমনটা নয়, তবে তিন ভাগ করাটা উত্তম বলে বেশির ভাগ স্কলাররা মত দিয়েছেন।

১. এক-তৃতীয়াংশ গরিব ও দুঃস্থদের
২. এক-তৃতীয়াংশ আত্মীয়-স্বজন ও বন্ধুবান্ধবদের
৩. এক-তৃতীয়াংশ নিজের পরিবারের জন্য

“তারা যেন সে পশুর গোশ্ত নিজেরা খায় এবং অভাবগ্রস্তদের খাওয়ায়।”
সূরা হজ্জ, আয়াত ২৮

ঈদুল আযহার নামাজের পর থেকে শুরু হয় কোরবানির সময়। কোরবানির সময় তিন দিন: ১০, ১১, ও ১২ জিলহজ পর্যন্ত। নামাজের আগে কোরবানি করলে তা গৃহপালিত পশু জবাই হিসেবে গণ্য হবে, কোরবানি নয়।
(সহিহ বুখারি, হাদিস: ৫৫৫৫)

কোরবানির মূল শিক্ষা কী?

আত্মত্যাগ আনুগত্য:
ইব্রাহিম (আ.)-এর মতো আমাদেরও আল্লাহর হুকুমে আত্মোৎসর্গের মানসিকতা থাকতে হবে।

সমাজের দরিদ্রদের পাশে দাঁড়ানো:
কোরবানির মাধ্যমে দরিদ্র ও সুবিধাবঞ্চিত মানুষের মুখে হাসি ফোটানো ইসলামের অন্যতম উদ্দেশ্য।

আত্মশুদ্ধি তাকওয়া:
কোরবানি আমাদের আত্মাকে পরিশুদ্ধ করে এবং আল্লাহর প্রতি আনুগত্য জাগিয়ে তোলে।

কোরবানি কেবল একটি ধর্মীয় আচার নয়; বরং এটি একটি আত্মিক, সামাজিক ও নৈতিক অনুশীলন। এতে আত্মত্যাগ, সাম্য, সহমর্মিতা ও আল্লাহর সন্তুষ্টি অর্জনের গভীর শিক্ষা রয়েছে। ইসলামের প্রকৃত মর্মবাণী বুঝে যদি আমরা কোরবানি পালন করি, তবে সমাজ হবে আরও মানবিক, সহানুভূতিশীল ও আলোকিত।

Exit mobile version