সৈয়দ মুজিবুর রহমান দুলাল, লাকসাম: কুমিল্লার লাকসামে অবস্থিত উপমহাদেশের প্রথম মুসলিম ও একমাত্র মহিলা নবাব নারী জাগরণ ও নারী শিক্ষার অগ্রদূত একুশে পদক প্রাপ্ত (মরণোত্তর) প্রজাহিতৈষী জমিদার নবাব ফয়জুন্নেছা চৌধুরানী।
প্রায় ১৫২ বছর আগে বেগম রোকেয়ারও জন্মের সাত বছর পূর্বে নারী শিক্ষার প্রসারে ১৮৭৩ সালে তিনি কুমিল্লা শহরের
বাদুড়তলায় প্রতিষ্ঠা করেন ‘ফয়জুন্নেছা উচ্চ বালিকা বিদ্যালয়’। ওই বিদ্যালয় থেকে চলতি বছর এসএসসি পরীক্ষায় অংশ নেওয়া ২৪০জন শিক্ষার্থী গতকাল সোমবার (১৯ মে) লাকসামের পশ্চিমগাঁওয়ে নবাব ফয়জুন্নেছার বাড়ি পরিদর্শনে আসে। তাদের সঙ্গে ছিলেন বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক রাশেদা আক্তারসহ আরো ছয় শিক্ষক।
গতকাল ছিলো ১৯ মে আন্তর্জাতিক জাদুঘর দিবস। দিবসটি উপলক্ষে রাজধানীর শাহবাগে বর্ণাঢ্য শোভাযাত্রার আয়োজন করে জাতীয় জাদুঘর কর্তৃপক্ষ।
এ দিকে লাকসামে নবাব ফয়জুন্নেছার স্মৃতি বিজড়িত জাতীয় জাদুঘরের শাখা ‘লাকসামে নবাব ফয়জুন্নেছা জমিদার বাড়ি জাদুঘরের জন্য দিনটি ছিলো যথেষ্ট তাৎপর্যপুর্ন। সকাল থেকেই দর্শনার্থীদের পদচারণা ও আনন্দ-উচ্ছ্বাস আর কোলাহলে ছিলো মুখরিত।
ওইদিন সকাল ৯টার দিকে কুমিল্লার ‘ফয়জুন্নেছা সরকারি উচ্চ বালিকা বিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা ৬টি বাসযোগে লাকসামের পশ্চিমগাঁওয়ে নবাব ফয়জুন্নেছার বাড়ি এসে পৌঁছায়। বেলা দুইটা পর্যন্ত তারা নবাব ফয়জুন্নেছার স্থাপত্যশৈলীর অনন্য নিদর্শন বাড়িটি ঘুরে দেখে এবং আনন্দ-উচ্ছ্বাসে মেতে ওঠে। শিক্ষার্থীরা তাঁর কবরে শ্রদ্ধা জানায়।
নারী শিক্ষার অগ্রদূত নবাব ফয়জুন্নেছা চৌধুরীরাণীর বাড়িটি পরিদর্শনের সময় শিক্ষার্থীরা ওই মহিয়সী নারীর জীবনী পাঠ্যবইয়ে অন্তর্ভুক্ত করার দাবি জানায়। এ ছাড়া নবাব বাড়িতে প্রবেশের একটি ঐতিহাসিক পথ বন্ধ করে সীমানাপ্রাচীর নির্মাণের ঘটনায় ক্ষোভ প্রকাশ করেন শিক্ষক-শিক্ষার্থীরা।
জানা গেছে, স্থানীয় এক প্রভাবশালী ব্যক্তি জমি দখল করে নবাব বাড়ির দক্ষিণ-পূর্ব পাশের ফটকের সামনে প্রাচীর নির্মাণ করছেন। ফলে চলাচলের ঐতিহাসিক ফটকটি বন্ধ হয়ে গেছে।
অপরদিকে সকাল ১০টায় লাকসাম উপজেলা প্রশাসন আয়োজন করে ফয়েজুন্নেছা বিতর্ক উৎসবের উদ্বোধনী অনুষ্ঠান । এই আয়োজনের সহযোগিতায় ছিলো লাকসাম পৌরসভা।
নবাব ফয়জুন্নেছার জীবন, জনহিতকর কর্ম নিয়ে হয় আলোচনা। ব্যতিক্রমধর্মী এই আয়োজন সরকারের কর্মকর্তা,বিভিন্ন শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের বিতার্কিক ও শিক্ষকদের পদচাণায় মুখরিত ছিলো নবাব ফয়জুন্নেছা জমিদার বাড়ি জাদুঘর ও উপজেলা পরিষদ কমপ্লেক্স মিলনায়তন।
১৮৩৪ সালে লাকসামের পশ্চিমগাঁওয়ে জন্ম নেওয়া নবাব ফয়জুন্নেছা চৌধুরানী ছিলেন প্রজাহিতৈষী জমিদার, সমাজসেবক ও শিক্ষানুরাগী। ১৮৭৩ সালে, বেগম রোকেয়ার জন্মের ৭ বছর আগে, তিনি কুমিল্লা নগরের বাদুড়তলায় মেয়েদের জন্য নিজ নামে একটি মাধ্যমিক বিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা করেন। এ ছাড়াও কুমিল্লার নানুয়া দিঘির পাড়ে একটি প্রাথমিক বিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা করেন। পরবর্তীতে এটি ‘শৈলরাণী প্রাথমিক বিদ্যালয়’ হিসেবে নামকরণ করা হয়।
কুমিল্লা জেলার লাকসাম উপজেলাধীন (তৎকালীন ত্রিপুরা জেলার হোমনাবাদ পরগণা) পশ্চিমগাঁও গ্রামে জমিদার পরিবারে ১৮৩৪ সালে তিনি জণ্মগ্রহন করেন। জমিদার আহমেদ আলী চৌধুরী ও আরফান্নেছা চৌধুরাণীর পাঁচ সন্তানের মধ্যে প্রথম কন্যা সন্তান ফয়জুন্নেছা চৌধুরাণী। তাঁর পিতা আহমেদ আলী চৌধুরীর পূর্ব পুরুষ দিল্লির বাদশাহ শাহ্ আলমের কাছ থেকে সনদ লাভ করে হোমনাবাদ পরগণার জমিদার হন।
নবাব ফয়জুন্নেছা চৌধুরাণী মুসলমানদের কঠিন পর্দা প্রথার মধ্যে থেকেও নিজের একান্ত আগ্রহেই পারিবারিক গৃহশিক্ষকের মাধ্যমে আরবি, ফার্সী, বাংলা ও সংস্কৃত ভাষায় জ্ঞান অর্জন করেন। জমিদারি পরিচালনার পাশাপাশি তিনি শিক্ষা, স্বাস্থ্য, সমাজসেবাই শুধু নয় সাহিত্য সাধনায়ও অনন্য অবদান রেখেছিলেন। ১৮৭৬ সালে গদ্যে ও পদ্যে রচিত রুপক ও ব্যতিক্রমধর্মী ৪১৭ পৃষ্ঠার ‘রুপ-জালাল ‘ গ্রন্থে তিনি কৌশলে তাঁর স্বীয় জীবনের ছায়াপাত ঘটিয়েছেন। তিনি ছিলেন বৃটিশ ভারতের প্রথম মহিলা কবি।’ সঙ্গীতসার’ ও ‘ সঙ্গীতলহরী ‘ নামে তাঁর দুটি কবিতার বই প্রকাশিত হয়েছে। কলকাতা থেকে প্রকাশিত সুধাকর ও মুসলমান বন্ধু নামে দুটি পত্রিকার প্রধান পৃষ্ঠপোষক ছিলেন ফয়জুন্নেছা। এ ছাড়াও বান্ধব, ঢাকা প্রকাশ ও ইসলাম প্রচারক প্রভূত বাংলা পত্র পত্রিকার প্রকাশনায় নিয়মিতভাবে আর্থিক সহায়তা করতেন। ইংরেজি শিক্ষা তথা নারী শিক্ষার প্রতি তাঁর বিশেষ অনুরাগ ছিল। তাঁর গৃহে পারিবারিক লাইব্রেরীতে তিনি নিয়মিত পড়ালেখা করতেন।
১৯০৩ সালের ২৩ সেপ্টেম্বর তিনি মৃত্যুবরণ করেন। নিজ বাড়ির পশ্চিম দিকে নির্মিত স্থাপত্যশৈলীর নিদর্শণ দশ গম্বুজ বিশিষ্ট মসজিদের পাশে চিরনিদ্রায় শায়িত আছেন এই মহিয়সী নারী।
কুমিল্লার ‘ফয়জুন্নেছা সরকারি উচ্চ বালিকা বিদ্যালয়ের এসএসসি পরীক্ষার্থী আদিবা বিনতে আজাদ বলে, নবাব ফয়জুন্নেছার বাড়ি ঘুরে দেখতে পেরে খুব ভালো লাগছে। নবাব ফয়জুন্নেছার জীবনী শিক্ষার্থীদের অনুপ্রাণিত করবে, তাই সেটি দ্রুত পাঠ্যবইয়ে অন্তর্ভুক্ত করা উচিত। আরেক শিক্ষার্থী আফরা ইসলাম বলে, সহপাঠীদের সঙ্গে দিনটি বেশ দারুণ কেটেছে। এ ছাড়া, আমাদের বিদ্যালয়ের প্রতিষ্ঠাতার কবর জিয়ারত করে শ্রদ্ধা জানাতে পেরে অনেক ভালো লেগেছে।
কুমিল্লা ফয়জুন্নেছা সরকারি বালিকা উচ্চ বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক রাশেদা আক্তার বলেন, ‘আজকের প্রজন্মের শিক্ষার্থীরা তাদের বিদ্যালয়ের প্রতিষ্ঠাতার বাড়িতে এসেছে। তারা ঐতিহাসিক এ বাড়িটি ঘুরে দেখে মুগ্ধ হয়েছে। ভাবতেই অবাক লাগে, বেগম রোকেয়ার জন্মের আগেই নবাব ফয়জুন্নেছা নারী শিক্ষার সূচনা করেছিলেন। তাঁর জীবনী অনেক আগেই পাঠ্যবইয়ে অন্তর্ভুক্ত হওয়া উচিত ছিল। আমরা দীর্ঘদিন ধরে এ দাবি জানিয়ে আসছি।’
রাশেদা আক্তার আরও বলেন, ‘নবাব বাড়ির যে ঐতিহাসিক ফটক দিয়ে নবাব ফয়জুন্নেছা চৌধুরানী হাতি ও ঘোড়া নিয়ে চলাচল করতেন, সেটি বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে। এটি দেখে খুবই খারাপ লেগেছে। আমরা দ্রুত ওই ফটকটি উন্মুক্ত করার
দাবি জানাচ্ছি।’ কুমিল্লা ফয়জুন্নেছা সরকারি বালিকা উচ্চ বিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ ‘নবাব ফয়জুন্নেছার’ নামে কুমিল্লায় অথবা লাকসামে একটি বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠারও দাবি জানান।
লাকসাম উপজেলা দুর্নীতি প্রতিরোধ কমিটির (দুপ্রক) সাবেক সভাপতি ও লাকসাম প্রেস ক্লাবের সাবেক ভারপ্রাপ্ত সভাপতি প্রবীণ সাংবাদিক সৈয়দ মুজিবুর রহমান দুলাল জানান, নবাব ফয়জুন্নেছা চৌধুরানী তাঁর জমিদারীর ১৪টি মৌজায় স্থাপন করেছেন প্রথমিক বিদ্যালয়, মক্তব, মাদরাসা, মাধ্যমিক বিদ্যালয়, কলেজসহ অসংখ্য শিক্ষা প্রতিষ্ঠান। কুমিল্লা ভিক্টোরিয়া কলেজ প্রতিষ্ঠায়ও আর্থিক অনুদান দেন তিনি। তিনি দেশের গন্ডি পেরিয়ে ভারতের নদীয়া জেলার কৃষ্ণনগরেও একটি প্রাথমিক বিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা করেন।
তিনি বলেন, চিকিৎসা সেবায় রয়েছে তাঁর অন্য অবদান। নারী স্বাস্থ্য সেবায় ১৮৯৩ সালে তিনি কুমিল্লায় ফয়জুন্নেছা মহিলা ওয়ার্ড প্রতিষ্ঠা করেন। যাহা বতর্মানে কুমিল্লা জেনারেল হাসপাতালের সঙ্গে সম্পৃক্ত। তাঁর দানে প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল লাকসাম দাতব্য চিকিৎসালয়। সমাজসেবায় অবদানের স্বীকৃতিস্বরূপ তাঁকে ২০০৪ সালে একুশে পদকে (মরণোত্তর) ভূষিত করা হয়।
প্রাথমিক, মাধ্যমিক ও উচ্চ মাধ্যমিক পর্যায়ে পাঠ্য বইয়ে নবাব ফয়জুন্নেছার জীবনী অন্তর্ভুক্ত করার জন্য সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের নিকট দাবি জানান প্রবীণ এ সাংবাদিক।
জাতীয় জাদুঘরের শাখা ‘নবাব ফয়জুন্নেছা জমিদার বাড়ি জাদুঘরের’ রক্ষণাবেক্ষণ ও দর্শনার্থীদের তত্ত্বাবধানে দায়িত্ব পালন করছেন মো. আনোয়ার হোসেন।
তিনি বলেন, কুমিল্লার ফয়জুন্নেছা সরকারি বালিকা উচ্চ বিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা এখানে আসায় নবাববাড়ি প্রাঙ্গণ দিনভর মুখোরিত ছিলো।
লাকসামের অনেক ইতিহাস-ঐতিহ্যের কালের স্বাক্ষী প্রবীণ ব্যক্তি ও সাবেক ইউপি চেয়ারম্যান মো. মোস্তাফিজুর রহমান বলেন, নবাব ফয়জুন্নেছার স্মৃতিবিজড়িত দৃষ্টিনন্দন এই বাড়িটি অষ্টাদশ শতাব্দীর মধ্যভাগে নির্মিত বলে ধারণা করা হয়। তাঁর জীবনী পাঠ্যবইয়ে অন্তর্ভুক্ত করা এখন সময়ের দাবি। এটি লাকসাম তথা কুমিল্লাবাসীর দীর্ঘদিনের প্রাণের দাবি।