ক্ষমতাচ্যুত আওয়ামী লীগ সরকারের সাবেক প্রধানমন্ত্রী ও তার পরিবারসহ ঘনিষ্ঠ ১০টি শীর্ষ ব্যবসায়ী গোষ্ঠীর বিরুদ্ধে অর্থপাচার এবং দুর্নীতির অভিযোগে ছয়টি সরকারি সংস্থা অগ্রাধিকার ভিত্তিতে তদন্ত চালাচ্ছে। এসব তদন্তে সংযুক্ত আরব আমিরাতে (ইউএই) তাদের বিপুল সম্পদ ও বিনিয়োগের সন্ধান পাওয়া গেছে। এই অর্থসম্পদ দিয়ে সেখানে নামে-বেনামে ব্যবসা পরিচালনার তথ্যও উঠে এসেছে। এমনকি সাবেক প্রধানমন্ত্রীর পরিবারের এক আত্মীয়ের নামেও বিপুল পরিমাণ সম্পদের তথ্য উদ্ঘাটিত হয়েছে। পাশাপাশি, আওয়ামী লীগের আরও অনেক শীর্ষ নেতা ও নীতিনির্ধারকের ইউএইতে অর্থ পাচারের প্রমাণ মিলেছে।
দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক), বাংলাদেশ ব্যাংক, বাংলাদেশ আর্থিক গোয়েন্দা ইউনিট (বিএফআইইউ), সদ্য বিলুপ্ত জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর), বাংলাদেশ সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশন (বিএসইসি) এবং অপরাধ তদন্ত বিভাগ (সিআইডি)—এই ছয়টি সংস্থা সমন্বিতভাবে তদন্ত চালাচ্ছে। এরই মধ্যে বেশ কিছু মামলাও দায়ের করা হয়েছে। প্রাথমিক তদন্তে ইউএইতে যেসব সম্পদ ও বিনিয়োগের তথ্য পাওয়া গেছে, তা ফেরত আনার জন্য বাংলাদেশের কেন্দ্রীয় ব্যাংকের গভর্নর বর্তমানে আমিরাত সফর করছেন। এই সফরে তিনি ইউএই-এর ফিন্যান্সিয়াল ইন্টেলিজেন্স ইউনিট (ইউএই এফআইইউ), দেশটির কেন্দ্রীয় ব্যাংক এবং স্থানীয় প্রবাসী ব্যবসায়ীদের সঙ্গে বৈঠক করছেন।
তদন্তে সাবেক ভূমিমন্ত্রী ও আরামিট গ্রুপের কর্ণধার সাইফুজ্জামান চৌধুরীর নামে ইউএইতে ২২৮টি সম্পত্তির তথ্য পাওয়া গেছে। এসব সম্পত্তির বেশিরভাগই অভিজাত এলাকা ও বিলাসবহুল ফ্ল্যাট, যেগুলোর মালিকানা তার পরিবারের সদস্যদের নামে রেজিস্ট্রিকৃত। সেখানে নিয়মিত ফ্ল্যাট কেনাবেচা এবং ব্যবসা পরিচালনা হচ্ছে। সরকারের পক্ষ থেকে এসব সম্পদ ফেরত আনার জন্য আইনগত পদক্ষেপ নেওয়া হচ্ছে। বিএফআইইউ এরই মধ্যে দেশটির কাছে যৌথ আইনি সহায়তার (MLAR) আবেদন পাঠিয়েছে।
বেক্সিমকো গ্রুপের কর্ণধার সালমান এফ রহমানের নামে-বেনামে আমিরাতে বিপুল পরিমাণ অর্থ পাচারের প্রমাণ মিলেছে। ট্রেজ বেইড মানি লন্ডারিংয়ের মাধ্যমে তিনি দেশটিতে ৮ কোটি ৩০ লাখ ডলার পাচার করেছেন বলে প্রাথমিক তদন্তে জানা গেছে। এসব অর্থে শেল কোম্পানি গঠন করে বিভিন্ন দেশে বিনিয়োগ চালিয়ে যাচ্ছেন তিনি। একই মালিকানায় প্রতিষ্ঠিত বিভিন্ন কোম্পানির মাধ্যমে তিনি ব্যবসা পরিচালনা করছেন, যা রপ্তানির অর্থ দেশে না এনে বিদেশে পাচার করার পথ তৈরি করেছে।
ওরিয়ন গ্রুপের কর্ণধার ওবায়দুল করিম এবং তার সহযোগীদের নামেও আমিরাতে সম্পদ ও বিনিয়োগের তথ্য পাওয়া গেছে। তারা আলবেনিয়ার নাগরিকত্ব গ্রহণ করে সেই পরিচয় ব্যবহার করে আমিরাতে বিনিয়োগ করেছেন।
প্রয়াত ব্যবসায়ী কাজী শাহেদ আহমেদের প্রতিষ্ঠিত জেমকম গ্রুপ এবং নাসা গ্রুপের কর্ণধার নজরুল ইসলাম মজুমদারের নামেও বিপুল সম্পদের তথ্য পাওয়া গেছে। তাদের পরিবারের সদস্যদের নামে শেল কোম্পানি তৈরি করে বিদেশে ব্যবসা পরিচালনা করা হচ্ছে।
শেখ হাসিনা সরকারের শাসনামলে তার পরিবারের এক আত্মীয়ের নামে ইউএইতে বিশাল সম্পদ গড়ে তোলা হয়েছে। দেশের পাচার করা অর্থের একটি বড় অংশ দিয়ে এই সম্পদ তৈরি হয়েছে বলে অভিযোগ উঠেছে। সরকারের পক্ষ থেকে এই অর্থ ফেরত আনার প্রক্রিয়া শুরু হয়েছে।
তদন্ত প্রতিবেদনে আরও জানা যায়, বাংলাদেশ থেকে ১০টি দেশে সবচেয়ে বেশি অর্থ পাচার হয়েছে। দেশগুলো হলো—কানাডা, যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য, সিঙ্গাপুর, মালয়েশিয়া, সংযুক্ত আরব আমিরাত, সুইজারল্যান্ড, থাইল্যান্ড, হংকং এবং চীন। সরকার এই সব দেশ থেকে অর্থ ফিরিয়ে আনতে মিউচুয়াল লিগ্যাল অ্যাসিস্টেন্স চুক্তি (MLAT) করার উদ্যোগ নিয়েছে। ইতিমধ্যে মালয়েশিয়া ও আমিরাতের সঙ্গে চুক্তির খসড়া চূড়ান্ত করা হয়েছে।
বাংলাদেশ আর্থিক গোয়েন্দা ইউনিট (বিএফআইইউ) ৮১টি দেশের সঙ্গে সমঝোতা স্মারক স্বাক্ষর করেছে, যার মধ্যে ইউএই অন্যতম। এ ছাড়া আন্তর্জাতিক মানি লন্ডারিং প্রতিরোধে কাজ করা সংস্থাগুলোর সঙ্গেও যোগাযোগ রক্ষা করে চলছে। পাচার করা অর্থ ফেরত আনার প্রক্রিয়াকে ত্বরান্বিত করতে এসব চুক্তিকে কার্যকর করার উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে।