আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে সংসদ সদস্য থাকা কাজী নাবিল আহমেদের বিরুদ্ধে অর্থপাচারের অভিযোগ পাওয়া গেছে। দেশটির একটি চা কম্পানিতে কাজী নাবিল ও তাঁর দুই ভাইয়ের নামে প্রায় ২১৫ কোটি টাকা (১৮ মিলিয়ন ডলার) বিনিয়োগ করা হয়েছে বলে জানা গেছে। বিপুল অঙ্কের এই বিনিয়োগের তথ্য নিজের নির্বাচনী হলফনামায় গোপন রেখেছিলেন কাজী নাবিল। এর বাইরেও বিদেশে হাজার কোটি টাকার বেশি সম্পত্তি রয়েছে তার ও তার ভাইদের নামে।
চলতি বছরের ১২ এপ্রিল লন্ডনের রয়াল কোর্ট অব জাস্টিসের এক শুনানি থেকে সংসদ সদস্য নাবিলের যুক্তরাজ্যে বিনিয়োগের তথ্য উঠে আসে।
তিনি জেমকন গ্রুপের মালিক। প্রতিষ্ঠানটির মালিকানায় কাজী নাবিল আহমেদ ছাড়াও তাঁর দুই ভাই কাজী আনিস আহমেদ ও কাজী ইনাম আহমেদও রয়েছেন।
আদালতের শুনানিতে তাঁরা যুক্তরাজ্যের একটি কম্পানিতে বিনিয়োগের কথা বলেছিলেন। কিন্তু এই তথ্য তিনি দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের হলফনামায় উল্লেখ করেননি।
শুধু তা-ই নয়, ২০১৮ থেকে ২০২৪ সালের মধ্যে নাবিলের আয় বেড়েছে হাজার শতাংশেরও বেশি। সেটিও জাতীয় নির্বাচনের হলফনামায় উল্লেখ করেননি। তাঁদের বিরুদ্ধে বর্তমানে তদন্ত করছে দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক)।
তথ্য বলছে, ১৯৭১ থেকে ২০২৩ সালের মধ্যে যেসব কম্পানিকে বাংলাদেশ ব্যাংক থেকে বিদেশে বিনিয়োগ করার জন্য অনুমোদন দেওয়া হয়েছে, তাতে জেমকন গ্রুপের নাম নেই।
এদিকে কম্পানিটির ব্যাংক স্টেটমেন্টে দেখা যায়, ২০২০ থেকে ২০২১ সাল পর্যন্ত যে অর্থ যুক্তরাজ্যের ওই কম্পানিতে বিনিয়োগ করা হয়েছে সেটা বাংলাদেশ থেকে স্থানান্তর করা হয়নি। বরং বিনিয়োগের অর্থ এসেছে সিঙ্গাপুর ও দুবাইয়ের একটি ফার্ম থেকে। দুবাইয়ের ওই ফার্মটির মালিক কাজী আনিস আহমেদ।
যুক্তরাজ্যের আদালত থেকে শুনানির নথিতে দেখা যায়, নাবিল ও তাঁর দুই ভাই যুক্তরাজ্যভিত্তিক ব্যাবসায়িক অংশীদারের বিরুদ্ধে নিষেধাজ্ঞার জন্য লড়াই করেছেন, যাতে তাঁর ব্যবসা প্রতিষ্ঠার জন্য বাংলাদেশ থেকে অর্থপাচারের বিষয়টি প্রকাশ না পায়।
ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশের (টিআইবি) বিশ্লেষণ অনুসারে দেখা যায়, তিনি বিভিন্ন ব্যাংক থেকে প্রায় ৯০০ কোটি টাকা ঋণ নিয়েছেন।
এই পরিমাণ অর্থ ব্যাংক থেকে যেসব এমপি ঋণ নিয়েছেন সে তালিকায় শীর্ষ পাঁচজনের মধ্যে তিনি একজন। টিআইবির তথ্যে আরো দেখা যায়, তিনি ব্যাবসায়িক শেয়ারে ২৪ কোটি টাকা বিনিয়োগের কথা উল্লেখ করেছেন।
সম্প্রতি তিনি ব্রিটিশ ফার্ম টিটুলিয়া ইউকে লিমিটেডের ২.৭ মিলিয়ন পাউন্ডের (৩৯ কোটি ৫০ লাখ টাকা) আর্থিক বিবরণী দুদকের কাছে জমা দিয়েছেন। কম্পানিটি বাংলাদেশ থেকে চা আমদানি ও বাজারজাত করে। ২০০৭ সালের ২৯ নভেম্বর কাজী নাবিল এবং তাঁর দুই ভাই কাজী আনিস ও কাজী ইনাম কম্পানিটি প্রতিষ্ঠা করেন। কম্পানিটির নথিতে দেখা যায়, ২০১০ সালে এই কম্পানির মালিক হিসেবে লিন্ডা অ্যাপেল লিপসিয়াস নামের আরো এক মার্কিন নাগরিককে যুক্ত করা হয়।
নথি অনুসারে আরো জানা যায়, নাবিল ও তাঁর ভাইয়েরা ২০২০ সালের নভেম্বর পর্যন্ত কম্পানিটিতে ১৮ মিলিয়ন ডলারের (২১৫ কোটি টাকা) বেশি বিনিয়োগ করেছেন। বর্তমানে যুক্তরাষ্ট্র ও যুক্তরাজ্যে তাঁদের বিনিয়োগের মোট মূল্য প্রায় ২৫৪ কোটি ৫০ লাখ টাকা।
নাবিল, আনিস ও ইনামের আইনজীবী এন হ্যামিল্টন আদালতকে বলেন, ‘আমার মক্কেলরা টিটুলিয়ার (ইউকে) বিনিয়োগকারী ছিলেন। সেখান থেকেই সব টাকা এসেছে।’
তবে কম্পানিতে বিনিয়োগ করার জন্য এই অর্থ তাঁরা কোথায় পেয়েছেন তা প্রকাশ করেননি আইনজীবী হ্যামিল্টন; যদিও ২০২০ থেকে ২০২২ সাল পর্যন্ত তিনটি কম্পানির মোট ১০টি লেনদেনের মাধ্যমে এই কম্পানিতে বিনিয়োগ করার তথ্য পাওয়া গেছে। কম্পানি তিনটি হলো দুবাইভিত্তিক ডাবল কোর জেনারেল ট্রেডিং এলএলসি, আরামেক্স ইন্টারন্যাশনাল এবং সিঙ্গাপুরভিত্তিক গ্লোবাল বিজ ইমপোর্ট এক্সপোর্ট পিটিই লিমিটেড।
সংযুক্ত আরব আমিরাতের জাতীয় অর্থনৈতিক রেজিস্টার থেকে রেকর্ডকৃত একটি অনুলিপি ও কম্পানি শোর বাণিজ্যিক লাইসেন্স থেকে দেখা যায়, ২০২৩ সালে কম্পানিটি কাজ বন্ধের পর টিটুলিয়া যুক্তরাজ্যের লিকুইডেশন রিপোর্টে শুধু ডাবল কোরকে কম্পানিটির বিনিয়োগকারী হিসেবে উল্লেখ করে। আর মালিক হিসেবে কাজী আনিস, কানাডিয়ান নাগরিক মোহাম্মদ সোহেল রানা এবং আমিরাতের আবদুল্লাহ হাসান আলী নামের এক নাগরিককে দেখানো হয়েছে। এটি দিরা আল মুরার নামের একটি আবাসিক এলাকায় অবস্থিত।
কম্পানিটির লিকুইডেশন রিপোর্টে দেখা যায়, ২০২০ সালে কম্পানিটি ২৫ হাজার ২৪৭ পাউন্ড মুনাফা অর্জন করেছে। অথচ ব্যবসা শুরু করার আগে সংস্কারের জন্যই এটি ব্যয় করেছিল পাঁচ লাখ পাউন্ড। এই ব্যবসাটির অংশীদার ও পরিচালক ছিলেন আহসান আকবর নামের এক ব্যক্তি।