Thursday, August 21
Shadow

রাজনৈতিক ফ্যাসিবাদের পতন, কিন্তু কালচারাল ফ্যাসিজমের ছায়া এখনো বিস্তৃত

মাহবুব আলম 

রাজনৈতিক স্বৈরশাসনের পতন অনেক সময়ই জনতার বিজয়ের প্রতীক হয়ে ওঠে। ইতিহাস বলে, ক্ষমতার দমনচক্র একসময় থামে, জনগণ রাস্তায় নামে, শাসকের পতন ঘটে। কিন্তু প্রশ্ন হলো—শুধু একজন শাসকের সরে যাওয়া মানেই কি ফ্যাসিবাদের অবসান? দুর্ভাগ্যজনকভাবে, উত্তর হলো—না। কারণ, রাজনৈতিক ফ্যাসিবাদ যখন বিদায় নেয়, তখনও তার চিন্তা, চর্চা ও চেতনার উত্তরাধিকার বয়ে বেড়ায় এক শ্রেণির মানুষ—যাদের আমরা আজকাল চিহ্নিত করছি “কালচারাল ফ্যাসিস্ট” হিসেবে।

কালচারাল ফ্যাসিজম মূলত একটি চিন্তাগত ও মানসিক কাঠামো, যা সামাজিক সংস্কৃতি, মিডিয়া, শিক্ষা, ভাষা, শিল্প, সাহিত্য এমনকি ধর্মের মধ্য দিয়ে মানুষের মতামত, আচরণ ও চিন্তার ওপর নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা করে। এটি সরাসরি আইন দিয়ে নয়, বরং অনৈক্য, ভয়, মানসিক বিভ্রান্তি এবং তথাকথিত নৈতিক আধিপত্যের মাধ্যমে মানুষকে নিয়ন্ত্রণ করে। কালচারাল ফ্যাসিস্টরা বলে দেয়—কী বলা যাবে, কী ভাবা যাবে, কোন ইতিহাস পড়তে হবে, কোনটি ভুলে যেতে হবে।

তারা সরাসরি রাজনীতি করে না। কিন্তু রাজনীতির ‘মৌলিক কাঠামো’—মানুষের চিন্তা—তাদের নিয়ন্ত্রণেই চলে। তাই এক অর্থে, তারা রাজনৈতিক ফ্যাসিস্টদের চেয়েও ভয়ংকর, কারণ তাদের কার্যকলাপ দৃশ্যমান নয়, কিন্তু প্রভাব সুদূরপ্রসারী।

রাজনৈতিক ফ্যাসিবাদের পতন মানেই মুক্তি নয়। আমরা এমন অনেক দেশেই দেখেছি, যেখানে স্বৈরাচারী শাসকের পতনের পরও সমাজে বাকস্বাধীনতা, মতপ্রকাশ, ও চিন্তার মুক্তি প্রতিষ্ঠিত হয়নি। কারণ, সেই পতনের পরও কালচারাল ফ্যাসিস্টরা মিডিয়া, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান, সুশীল সমাজ এমনকি “প্রগতিশীল” তকমাধারী গোষ্ঠীর ভেতরে সক্রিয় থেকেছে। তারা জনগণের চিন্তাকে ঢেলে সাজায়, “ভবিষ্যতের বিপদ” দেখিয়ে অতীতের অন্যায়ের কথা ভুলিয়ে দেয়। এদের অস্ত্র হলো ন্যারেটিভ নির্মাণ—তথ্য দিয়ে নয়, ইমোশন দিয়ে পরিচালিত ইতিহাস।

আজকের বাস্তবতায় আমাদের সমাজ বাংলাদেশেও আমরা দেখতে পাই, কীভাবে কিছু তথাকথিত অভিজাত শ্রেণি, মিডিয়া ব্যক্তিত্ব, একাডেমিক মুখ, কিংবা সংস্কৃতির নেতারা বিরুদ্ধ মতকে “অপরাধ” বানিয়ে ফেলে। তারা ইতিহাসের সুবিধাজনক অংশটুকু সামনে আনে, আর অস্বস্তিকর সত্যকে আড়াল করে রাখে। কেউ প্রতিবাদ করলে তাকে “গণবিচ্ছিন্ন”, “উগ্র”, কিংবা “বিদ্বেষপ্রবণ” আখ্যা দেওয়া হয়। একসময় যা ছিল রাষ্ট্রীয় দমন-পীড়ন, এখন তা রূপ নিচ্ছে সামাজিক ও সাংস্কৃতিক বয়ানদখলে।

কেন এটা ভয়ংকর? কারণ, রাজনৈতিক শাসক পরিবর্তন করা যায়। কিন্তু কালচারাল ফ্যাসিস্টরা থেকে যায়—তারা সমাজের মনন কাঠামোতে ঢুকে পড়ে। তারা প্রজন্মের পর প্রজন্ম ধরে মতপ্রকাশের স্বাধীনতাকে গলা টিপে হত্যা করে। তারা তরুণদের সাহস নয়, নিরাপদ নীরবতা শেখায়।

করণীয় প্রথমত, কালচারাল ফ্যাসিজমকে চিনে ফেলতে হবে। এরা মুখে ‘মুক্তবুদ্ধি’ বললেও আসলে মতাদর্শিক একনায়কতন্ত্র কায়েম করতে চায়। দ্বিতীয়ত, বিকল্প সাংস্কৃতিক শক্তি গড়ে তুলতে হবে—যেখানে স্বাধীন ভাবনা, বৈচিত্র্য ও বিতর্ককে স্বাগত জানানো হবে। এবং তৃতীয়ত, সমাজের সচেতন নাগরিকদের ‘চুপ থাকা’র সংস্কৃতি থেকে বেরিয়ে আসতে হবে। মতের ভিন্নতা অপরাধ নয়, বরং গণতন্ত্রের সৌন্দর্য।

রাজনৈতিক পরিবর্তন প্রয়োজন, তবে তা যথেষ্ট নয়। যদি চিন্তার মুক্তি নিশ্চিত না হয়, যদি মতপ্রকাশের অধিকার সুরক্ষিত না থাকে, তবে ফ্যাসিবাদ শুধু শাসকের পোশাক বদলায়—স্বভাব বদলায় না। আজকের সমাজে তাই শুধু রাজনৈতিক নয়, সাংস্কৃতিক জাগরণও জরুরি। কালচারাল ফ্যাসিস্টদের মুখোশ ছিঁড়ে ফেলাই আজকের যুগের জরুরি কাজ।

লেখক: সহ দফতর সম্পাদক, সিলেট জেলা বিএনপি।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *