Monday, January 13
Shadow

নেপালের গুর্খা যোদ্ধারা কেন ভারতের সেনাবাহিনীতে যোগ দিতে চান?

নভেম্বরের শেষের শীতল সকালে নেপালের পোখরা শহরের একটি মনোরম মাঠে প্রায় ৬০ জন তরুণ শারীরিক অনুশীলনে ব্যস্ত। তাদের লক্ষ্য গুর্খা নিয়োগ প্রোগ্রামের মাধ্যমে ব্রিটিশ সেনাবাহিনী বা সিঙ্গাপুর পুলিশ বাহিনীতে যোগ দেওয়া। এই তরুণদের একজন, ১৯ বছর বয়সী শিশির ভট্টারি, বলেন, “শৈশব থেকেই আমার স্বপ্ন ছিল সেনাবাহিনীর সদস্য হওয়া। আমার মা সবসময় আমাকে এই স্বপ্ন পূরণে উৎসাহিত করেছেন।”

‘বিশ্বের সবচেয়ে সাহসী যোদ্ধা’
গুর্খারা দীর্ঘকাল ধরে ভারতীয় সেনাবাহিনীর একটি গুরুত্বপূর্ণ অংশ এবং ১৯৯৯ সালের কারগিল যুদ্ধে পাকিস্তানি সশস্ত্র গোষ্ঠীগুলোর বিরুদ্ধে লড়াইয়ে অংশ নিয়ে নিজেদের খ্যাতি অর্জন করেছেন।

১৮০০ সালের শুরুর দিকে ব্রিটিশ শাসনের সময় থেকেই ভারতীয় ভূখণ্ডে গুর্খাদের উপস্থিতি। স্বাধীনতার পর, ভারত, যুক্তরাজ্য এবং নেপালের মধ্যে একটি ত্রিপক্ষীয় চুক্তির মাধ্যমে ভারতীয় সেনাবাহিনীতে গুর্খাদের নিয়োগ অব্যাহত রাখা হয়।

নিয়োগ নীতির পরিবর্তন এবং ‘অগ্নিপথ’ প্রকল্প
২০২২ সালে ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির নেতৃত্বে ‘অগ্নিপথ’ নামে একটি নতুন নিয়োগ নীতি চালু হয়। এর আওতায় ১৭ থেকে ২১ বছর বয়সী তরুণ-তরুণীরা শুধুমাত্র চার বছরের জন্য সেনাবাহিনীতে যোগ দিতে পারবেন। এর পর মাত্র এক-চতুর্থাংশ নিয়োগপ্রাপ্ত সেনা স্থায়ী চাকরির সুযোগ পাবেন। অন্যরা অবসরে চলে যাবেন এবং পেনশন পাবেন না।

আগে গুর্খারা ১০ থেকে ১৭ বছর পর্যন্ত ভারতীয় সেনাবাহিনীতে চাকরি করতেন। কিন্তু এই নতুন নীতির প্রতিবাদে ২০২২ সালের আগস্টে নেপাল সরকার গুর্খাদের নিয়োগ স্থগিত করে।

গুর্খা প্রশিক্ষক ও সাবেক সম্মাননীয় ক্যাপ্টেন কৃষ্ণ বাহাদুর বলেন, “অগ্নিপথ প্রকল্প সম্পূর্ণ রাজনীতি দ্বারা প্রভাবিত। এটি নেপালের তরুণদের কর্মসংস্থানের ওপর বিরূপ প্রভাব ফেলেছে।”

নেপালের চাকরির অভাব
নেপালে পর্যাপ্ত কর্মসংস্থানের সুযোগ না থাকায় অনেক তরুণ বিদেশে সেনাবাহিনীতে যোগ দিচ্ছেন। ২০২২-২৩ সালে নেপালে বেকারত্বের হার ছিল ১২.৬ শতাংশ।

১৯ বছর বয়সী প্রিয়াশ গুরুং বলেন, “নেপালের সেনাবাহিনীতে চাকরি করে আর্থিকভাবে সুরক্ষা নিশ্চিত করা কঠিন। আমি ব্রিটিশ সেনাবাহিনীতে যোগ দেওয়ার জন্য প্রশিক্ষণ নিচ্ছি, যাতে আমার পরিবারকে আর্থিক সহায়তা করতে পারি।”

গুর্খাদের প্রাকৃতিক যুদ্ধক্ষেত্র দক্ষতা
গুর্খা প্রশিক্ষণের সময় তাদের ‘দোকো’ নামের ১৫ কেজি বালু ভর্তি ব্যাগ নিয়ে হিমালয়ের ঢাল বেয়ে দৌড়ানোর মতো কঠিন শারীরিক পরিশ্রম করতে হয়। এছাড়া তারা সাধারণ জ্ঞান থেকে গণিত পর্যন্ত বিভিন্ন বিষয়ে তাত্ত্বিক ক্লাসও করেন।

সালুট গুর্খা প্রশিক্ষণ কেন্দ্রের প্রধান কৃষ্ণ বাহাদুর বলেন, “গুর্খারা প্রাকৃতিক যোদ্ধা। তাদের সাহস, আনুগত্য এবং শৃঙ্খলা যেকোনো সেনাবাহিনীর জন্য সম্পদ।”

ভারতীয় সেনাবাহিনীতে গুর্খাদের অবদান
বর্তমানে ভারতীয় সেনাবাহিনীতে ৩২,০০০ এরও বেশি গুর্খা সদস্য রয়েছেন। নেপাল সরকার নিয়োগ স্থগিত করার আগে প্রতি বছর প্রায় ১,৩০০ থেকে ১,৫০০ গুর্খা নিয়োগ পেতেন।

২০ বছর বয়সী উজ্বল রাই, যিনি নেপালের ওখলধুঙ্গা জেলা থেকে এসেছেন, বলেন, “আমাদের সম্প্রদায় যুদ্ধক্ষেত্রে জন্মায়। আমাদের রক্তে গুর্খা সৈনিক হওয়ার দক্ষতা।”

উজ্বল বলেন, “আমার দাদু ভারতীয় সেনাবাহিনীতে ছিলেন। তিনি আমাকে তাদের প্রশিক্ষণ ও খাবারের কথা বলতেন। তার পথে হাঁটার ইচ্ছা থাকলেও এখন আমি সিঙ্গাপুর পুলিশ বাহিনীতে যোগ দেওয়ার জন্য প্রশিক্ষণ নিচ্ছি।”

গুর্খাদের কর্মসংস্থানের পথ খুলে দিতে এবং তাদের ঐতিহ্য রক্ষা করতে ভারত ও নেপালের সরকারের মধ্যে সহযোগিতা প্রয়োজন বলে মনে করছেন সংশ্লিষ্টরা।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *