
মোজাফফর হোসেন, ফেসবুক থেকে
আপনারা যারা উদ্বিগ্ন মিথিলার বিকিনি বাংলাদেশের মানসম্মান সব ডুবিয়ে দিলো ভেবে, তারা নিশ্চিত ও নিশ্চিন্ত থাকেন, নারীর বিকিনিতে দেশের মানসম্মান ডোবে না। মানসম্মান যায় ঘুষ দুর্নীতিতে, অপশাসন কুশাসনে। মানসম্মান যায় জোচ্চুরি আর মিথ্যাচারে। মানসম্মান যায় মূর্খামি আর ইতরামিতে। যেগুলো আপনারা নিশ্বাস গ্রহণের মতো অতি স্বাভাবিক করে তুলেছেন। দেশের মানসম্মান রক্ষার দায় মিথিলার বিকিনির উপর না চাপিয়ে নিজেদের স্বভাব-চরিত্রের উপর নিন, দেশের মঙ্গল হবে।
মিথিলার বিকিনিতে দেশের ভাবমূর্তি নষ্ট হচ্ছে ভেবে তার জীবন দুর্বিষহ করে তুলবেন না। ইউরোপ আমেরিকার প্রতিযোগীরাও আছেন একই পোশাকে, কিন্তু ওসব দেশের ভাবমূর্তি আপনার কাছে উজ্জ্বল, কারণ ঘুষে দুর্নীতি অপশাসনে তারা চ্যাম্পিয়ন কান্ট্রি না।
বিশ্বের অন্যতম দুর্নীতিপরায়ন দেশের নাগরিক আপনি, এটা নিয়ে ভাবেন। পাসপোর্ট রাংকিংয়ে বাংলাদেশের অবস্থান এখন তলানিতে, সেটা নিয়ে উদ্বিগ্ন হউন। বিশ্বের এক হাজার সেরা শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে দেশের কোনো বিশ্ববিদ্যালয় নেই, এটা ভেবে লজ্জা পান। দেশের স্বাস্থ্য ও চিকিৎসা ব্যবস্থা, দেশের আইন ও নিরাপত্তা ব্যবস্থা এসব নিয়ে উদ্বিগ্ন হন। মিথিলার বিকিনি নিয়ে এত উদ্বিগ্ন হওয়ার কিছু নাই। যেখানে যা পরার, সেখানে সেটাই পরেছে। ওখানে ওটাই স্বাভাবিকতা। ওখানে অংশ নেওয়াটা ওর চয়েস। ওর নির্দোষ স্বাধীনতা। সাপোর্ট না দেন, টেনে ধরার দরকার নেই।
গুডলাক মিথিলা।
উল্লেখ্য, মিস ইউনিভার্স এবং মিস ওয়ার্ল্ড দুটিই আন্তর্জাতিক সৌন্দর্য প্রতিযোগিতা। মিস ওয়ার্ল্ড ১৯৫১ সালে লন্ডন আর মিস ইউনিভার্স ১৯৫২ সালে নিউইয়র্ক থেকে শুরু হয়। মিস ওয়ার্ল্ড-এর মূলমন্ত্র হলো “Beauty with a Purpose”, যা মানবিক কর্মকাণ্ডকে গুরুত্ব দেয়, আর মিস ইউনিভার্সের মূলমন্ত্র হলো advocacy, নারীর ক্ষমতায়ন এখানে গুরুত্ব পায়।
তবে বিউটি প্রতিযোগিতার সঙ্গে নারীর ক্ষমতায়নের কোনো সম্পর্ক আছে কিনা তা নিয়ে জোর তর্ক আছে।
মিস কিংবা মিস্টার ওয়ার্ল্ড, যাই হোক না কেন–এটা মানুষকে পণ্য করে তোলে বলে অনেকে মনে করেন। তাদের বক্তব্য, নারীশক্তির প্রকাশ এইসব বিউটি কনটেস্টে চ্যাম্পিয়ন করার ভেতর দিয়ে ঘটবে না। নারীর জন্য যে বিউটি মিথ, মেজারমেন্টভিত্তিক সৌন্দর্যতা, সেটা পুঁজিবাদ ও পুরুষতন্ত্রের ফাঁদ। বিষয়টা নিয়ে লিখেছেন এই সময়ের প্রখ্যাত মার্কিন নারীবাদী লেখক নাওমি উলফ। ‘দ্য বিউটি মিথ’ (১৯৯১) বইটিতে তিনি দেখিয়েছেন যে ‘সৌন্দর্য’ নীতিবোধের মানদণ্ড হিসেবে বিবেচিত নয়। বরং সম্পূর্ণই সামাজিক বলয়ের রসায়নে সৃষ্ট একটা ধারণামাত্র। পুরুষতন্ত্র নিজের আধিপত্য বজায় রাখার জন্য এই নির্মাণ-বিনির্মাণের উপাত্তকে নির্ধারণ করে দেয় এবং পুরুষ তার স্বার্থেই সেগুলো ব্যবহার করে।
দ্য বিউটি মিথ শীর্ষক প্রবন্ধের কিছু অংশে তুলে দিচ্ছি। আমি পাক্ষিক অনন্যার জন্য বইটির নাম-প্রবন্ধটা অনুবাদ করিয়েছিলাম সাঈদা সানীকে দিয়ে। তাঁর অনুবাদ থেকে উদ্ধৃত করছি।
[…] ‘যতদিন পুরুষতন্ত্র থাকবে, ততদিন নিশ্চিতভাবেই সৌন্দর্যপুরাণ কোনো না কোনো আদলে টিকে থাকবে।..নারীর ওপর বস্তুগত নিয়ন্ত্রণ ভয়াবহভাবে শিথিল হয়ে যাওয়ার মাধ্যমে এই মিথ বা পুরাণ বিকশিত হয়ে উঠেছে। ইউরোপে শিল্প-বিপ্লবের আগে ‘সৌন্দর্য’ সম্পর্কে গড়পড়তা নারীর অনুভূতি আধুনিক নারীর মতো ছিল না। গণমাধ্যমে প্রচারিত দৈহিক আদর্শের অবিরাম তুল্য-ভিতের ওপর নির্মিত হলো সৌন্দর্যপুরাণের সৌধ।….
১৮৪০-এর দশকে প্রথমবারের মতো গণিকাদের নগ্ন ছবি তোলা হয়। এই শতকেরই মধ্যভাগে প্রথম সুন্দর নারীদের ছবি ব্যবহার করে বিজ্ঞাপন প্রকাশিত হয়। সুন্দরীদের আবক্ষ মূর্তির নতুন জোয়ার আসে, আর সেই বদ্ধভূমিতে ক্রমশ অবরুদ্ধ হয়ে পড়ে মধ্যবিত্ত নারীরা। শিল্প-বিপ্লবের সময় থেকেই, মধ্যবিত্ত পশ্চিমা নারীরা বস্তুগত চাপের মতোই আদর্শ এবং ছাঁচেঢালা নমুনা দ্বারা নিয়ন্ত্রিত হতে থাকে। এই ‘সাংস্কৃতিক ষড়যন্ত্র’ তাদের কাছে আপাতদৃষ্টিতে যুক্তিসংগত বলে মনে হয়। যার হাত ধরে উত্থান হয় সৌন্দর্যপুরাণের।
… বিপুল প্রভাবশালী বিশ্ববাজারের শিল্পকারখানায় বছরে তিন হাজার তিন শ কোটি ডলারের ডায়েট শিল্প, দুই হাজার কোটি ডলারের প্রসাধনী শিল্প, ৩০ কোটি ডলারের কসমেটিক সার্জারি শিল্প এবং সাত শ কোটি ডলারের পর্নোগ্রাফী শিল্প এখন বাস্তবতা। এই অর্থনৈতিক সাম্রাজ্য সৌন্দর্যপুরাণের ভ্রান্তিকেই ব্যবহার করে গড়ে উঠেছে।”
এখন ধরেন আমি নাওমি উলফের সঙ্গে একমত। তাই বলে কি আমি মিথিলার উপর ক্ষিপ্ত হবো?? নো। মোটেও না। নাওমি উলফ যে দেশের মানুষ সেদেশই মিস ইউনিভার্স প্রতিযোগিতার উদ্যোক্তা। তিনি আয়োজনকারী প্রতিষ্ঠান ভাঙচুরের কথা বলছেন না। তিনি কথা বলছেন মাইটি পুরুষতান্ত্রিক পুজিবাদী কাঠামো নিয়ে। একটা প্রতিষ্ঠিত সিস্টেমের বিরুদ্ধে ডায়লগ তৈরি করছেন। আমাদের দেশের যারা মিথিলার বিকিনি নিয়ে আপত্তি তুলছেন, আর নাওমির যে আপত্তি তাতে রাতদিন পার্থক্য। যে মোল্লাতন্ত্র আর পুরুষতান্ত্রিক মানসিকতার বিরুদ্ধে নাওমি কথা বলছেন, সেই একই পুরুষতান্ত্রিক মানসিকতা আমাদের এখানে মিথিলার বিরুদ্ধে সক্রিয়।
নাওমি উলফের আলোচনায় মিথিলা সাবজেক্ট না, সাবজেক্ট পুরুষতান্ত্রিক চিন্তা-কাঠামো, অন্যদিকে আমাদের দেশের চিন্তাগত মোল্লাদের সাবজেক্ট হল মিথিলা। কারণ তারা নিজেরাই পুরুষতান্ত্রিক চিন্তাকাঠামোর অংশ।
এই কারণে miss universe/mr universe বা miss world/mr world এসব ইভেন্টের আমি ক্রিটিক, কিন্তু তাতে মিথিলার জন্য শুভকামনা জানাতে কোনো অসুবিধা নাই।
পুনশ্চ: শুধু মিথিলা না, কোনো নারী বা পুরুষের পোশাকের সঙ্গে দেশের ভাবমূর্তি জড়িত না। ভাবমূর্তি জড়িত আচরণের সঙ্গে। মিথিলার সঙ্গে যে আচরণ আপনারা করছেন, ভাবমূর্তি বরঞ্চ তাতে নষ্ট হবে (অবশ্য এখনো যদি কিছু অবশিষ্ট থাকে)।
আচ্ছা অনেকের বক্তব্য, সুইমস্যুট রাউন্ডে বিকিনি পরে “আত্মসম্মান” বিসর্জন দেননি মিস পাকিস্তান, আরব আমিরাত ও মিস প্যালে-স্টা-ই-ন। তাতে পয়েন্ট কাটা গেছে, তারপরও। ভোট দিলে নাকি তাদের দেয়া উচিত!!
প্রশ্ন হলো নিয়ম জেনেও তারা কেন অংশ নিয়েছেন এই ইভেন্টে? “আত্মসম্মান” আরো বেশি রক্ষিত হতো অংশ না নিলে। তাদের তো কেউ জোর করেনি!! তারা যে ইভেন্টে অংশ নিয়েছে সেই ইভেন্টকে বরং অসম্মান জানিয়েছে, অসম্মান জানিয়েছে ফেলো অংশগ্রহণকারীদের। এমন না অর্ধ শরীর ঢেকে ইসলামধর্মের প্রচার ঘটিয়ে দিয়েছে। তালেবানরা এরপরও সুযোগ পেলে তাদের গলা কাটবে। বাই দ্য বাই, পর্নোগ্রাফি সার্চে পাকিস্তান কিন্তু বিশ্বে প্রথম দশ দেশের একটি।
