
শোয়েব সাম্য সিদ্দিক, ব্যাংকার ও অর্থনৈতিক বিশ্লেষক: বাংলাদেশের ব্যাংকগুলোতে বিপুল পরিমাণ অর্থ সঞ্চিত থাকলেও তা উৎপাদনমুখী খাতে প্রবাহিত হচ্ছে না। এই বৈপরীত্য দেশের অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি ও কর্মসংস্থান সৃষ্টি প্রক্রিয়ায় বাধা সৃষ্টি করছে। জুন ২০২৫-এর হিসাব অনুযায়ী, ব্যাংকগুলোতে মোট আমানত দাঁড়িয়েছে ১৮ লাখ ৭৭ হাজার ৫৬৫ কোটি টাকা। একই সময়ে উদ্বৃত্ত তারল্য বা লিকুইড অর্থের পরিমাণ পৌঁছেছে ২ লাখ ৬৬ হাজার কোটি টাকায়। অর্থাৎ ব্যাংকের কাছে বিপুল অর্থ রয়েছে, কিন্তু তা বিনিয়োগ বা উৎপাদনমুখী খাতে প্রবাহিত হচ্ছে না। তাত্ত্বিকভাবে ব্যাংকে অর্থের এই সঞ্চয় বিনিয়োগের জন্য সুযোগ তৈরি করে। তবে বাস্তবে দেখা যাচ্ছে, এই অর্থের একটি বড় অংশ নিরাপদ সরকারি ট্রেজারি বিল, বন্ড বা ব্যাংকের ভল্টে আটকে রয়েছে। ফলে কর্মসংস্থান সৃষ্টির গতি ধীর হচ্ছে, শিল্প ও উৎপাদনমূলক খাতে ঋণ প্রবাহ সীমিত হচ্ছে এবং অর্থনীতিতে কিছুটা স্থবিরতা দেখা দিচ্ছে।
উদ্বৃত্ত তারল্য বনাম বিনিয়োগ: বর্তমান চিত্র
বাংলাদেশের ব্যাংকিং খাতে জুন ২০২৫-এ উদ্বৃত্ত অর্থের পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ২ লাখ ৬৬ হাজার কোটি টাকা। একই সময়ে ব্যাংকে মোট আমানত ১৮ লাখ ৭৭ হাজার ৫৬৫ কোটি টাকা।
সূচক | জুন ২০২৪ | জুন ২০২৫ | পরিবর্তন |
মোট আমানত | ১৭,৪২,৫০০ কোটি টাকা | ১৮,৭৭,৫৬৫ কোটি টাকা | +১,৩৫,০৬৫ কোটি টাকা |
উদ্বৃত্ত তারল্য | ১,৬৯,০০০ কোটি টাকা | ২,৬৬,০০০ কোটি টাকা | +৯৭,০০০ কোটি টাকা |
মানুষের হাতে নগদ | ২,৯৩,৭৭৮ কোটি টাকা | ২,৯৬,৪৫১ কোটি টাকা | +২,৬৭৩ কোটি টাকা |
পরিসংখ্যান স্পষ্টভাবে দেখাচ্ছে যে, ব্যাংকের কাছে প্রচুর অর্থ থাকলেও তা বিনিয়োগে প্রবাহিত হচ্ছে না।
উদ্বৃত্ত তারল্য বৃদ্ধির কারণ –
১. বিনিয়োগের অনিশ্চয়তা: দেশের রাজনৈতিক ও প্রশাসনিক পরিবেশে কিছুটা অস্থিরতা দেখা যায়। বিনিয়োগকারীরা দীর্ঘমেয়াদী স্থিতিশীলতা না পেলে বড় প্রকল্পে অর্থ প্রবাহিত করতে কম আগ্রহী।
২. শক্তিশালী ব্যাংক বনাম ছোট ব্যাংক: ব্যাংকগুলোতে বড় ব্যাংকের তুলনায় ছোট ব্যাংকের খেলাপি ঋণ বেশি। জুন ২০২৫-এর হিসাব অনুযায়ী, ছোট ও মাঝারি ব্যাংকগুলোতে খেলাপি ঋণের হার গড়ে ১২%-১৫%, যেখানে বড় ব্যাংকগুলোতে এটি মাত্র ৫%-৭%। ফলে ব্যাংকগুলো নতুন ঋণ দিতে অতিরিক্ত সতর্ক হচ্ছে।
৩. ঋণের সুদহার: বর্তমান সময়ে ১৩–১৬ শতাংশের মধ্যে ঋণের সুদহার উদ্যোক্তাদের বিনিয়োগে কিছুটা দ্বিধা সৃষ্টি করছে।
৪. সিস্টেম লস ও অপচয়: ব্যাংকিং খাতে কিছু অদক্ষতা ও প্রযুক্তিগত সীমাবদ্ধতা রয়েছে। ডিজিটাল লেনদেন ও হিসাব সমন্বয়ের ক্ষেত্রে দেরি হলে ঋণ প্রদান ও বিনিয়োগের গতি কমে।
সিস্টেম লস ও দেশের অর্থনীতি
উদ্বৃত্ত অর্থ উৎপাদনমুখী খাতে না প্রবাহিত হলে দেশের অর্থনীতি ক্ষতিগ্রস্ত হয়। উদাহরণস্বরূপ, শিল্পের জন্য প্রয়োজনীয় মূলধনী যন্ত্রপাতির আমদানি গত তিন অর্থবছরে কমেছে—সর্বশেষ ২০২৪-২৫ অর্থবছরে প্রায় ২৫% হ্রাস। এর ফলে বেসরকারি খাতে ঋণ প্রবৃদ্ধি জুনে নেমে এসেছে ৬.৪০ শতাংশে, যা দেশের ইতিহাসে সর্বনিম্ন। এর ফলে নতুন বিনিয়োগ স্থগিত থাকে, উৎপাদন কমে এবং কর্মসংস্থানের সুযোগ সীমিত হয়।
সমাধানমুখী পদক্ষেপ
১. রাজনৈতিক ও প্রশাসনিক স্থিতিশীলতা: বিনিয়োগকারীদের আস্থা ফিরে আনতে নির্বাচনী প্রক্রিয়া ও নীতি-নির্ধারণে স্বচ্ছতা জরুরি। উদাহরণস্বরূপ, যদি নির্বাচনী পরিবেশ পূর্বানুমেয় হয়, ব্যবসায়ীরা সহজে ঋণ গ্রহণ করে নতুন প্রকল্পে বিনিয়োগ করবে।
২. ইনফ্রাস্ট্রাকচার ও জ্বালানি খাতের উন্নয়ন: বিদ্যুৎ ও গ্যাস সরবরাহে ধারাবাহিকতা নিশ্চিত করা হলে শিল্প উৎপাদনের গতি বাড়বে। জুন ২০২৫-এর তথ্য অনুযায়ী, বিদ্যুৎ ঘাটতি কিছু শিল্পাঞ্চলে উৎপাদন ব্যাহত করেছে।
৩. ব্যাংক খাতের সংস্কার: খেলাপি ঋণ কমানো, দুর্বল ব্যাংকের পুনর্গঠন এবং ঋণ প্রদানে স্বচ্ছতা বৃদ্ধি অপরিহার্য। ব্যাংকগুলোকে অগ্রাধিকার খাতে অর্থায়নে উৎসাহিত করলে উদ্বৃত্ত তারল্য কার্যকর বিনিয়োগে রূপ নেবে।
৪. সিস্টেম ও প্রযুক্তি উন্নয়ন: ব্যাংকের ডিজিটাল প্ল্যাটফর্ম এবং হিসাব-নিকাশের সক্ষমতা বৃদ্ধি করতে হবে। বড় ব্যাংকগুলো ইতিমধ্যেই উন্নত প্রযুক্তি ব্যবহার করছে। ছোট ব্যাংকগুলোর জন্যও এটি সম্প্রসারণ করা সম্ভব।
৫. ঋণপণ্যে বৈচিত্র্য: সবুজ অর্থায়ন, এসএমই, নবায়নযোগ্য জ্বালানি, কৃষি ও প্রযুক্তি খাতে বিনিয়োগের সুযোগ বাড়ানো উচিত। এতে অর্থ প্রবাহ বহুমুখী হবে।
বাংলাদেশের ব্যাংকের নীতি-দূরদর্শিতা –
বাংলাদেশ ব্যাংক বর্তমান সময়ে শুধুমাত্র ব্যাংকিং খাত নিয়ন্ত্রণে রাখছে না বরং দেশের অর্থনৈতিক স্থিতিশীলতা ও বিনিয়োগ প্রবাহ বাড়ানোর একটি সুদূরপ্রসারী নীতিও গ্রহণ করেছে। এর মাধ্যমে কেন্দ্রীয় ব্যাংক নিশ্চিত করছে যে ব্যাংকগুলোর উদ্বৃত্ত অর্থ কেবল ভল্টে জমে থাকছে না বরং তা উৎপাদনমুখী খাতে প্রবাহিত হবে।
মুদ্রাস্ফীতি নিয়ন্ত্রণ: জুন ২০২৫-এ মুদ্রাস্ফীতি ৮.৪৮%, যা গত ৩৫ মাসের মধ্যে সর্বনিম্ন। এটি প্রমাণ করে কেন্দ্রীয় ব্যাংক মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে সাফল্য পাচ্ছে, যা বিনিয়োগকারীদের জন্য দীর্ঘমেয়াদি পূর্বানুমেয়তা তৈরি করে। স্থিতিশীল মুদ্রাস্ফীতি নতুন প্রকল্প ও উদ্যোক্তাদের ঋণ গ্রহণে আত্মবিশ্বাস বৃদ্ধি করে।
ডলার রেট স্থিতিশীলতা: বাজারভিত্তিক ডলার রেট চালু হওয়ায় বৈদেশিক মুদ্রার বাজারে স্থিতিশীলতা এসেছে। এটি আমদানি-রফতানি খাতকে সুবিধা দেয় এবং বৈদেশিক বিনিয়োগকারীদের আস্থা বাড়ায়। রেমিট্যান্স প্রবাহও একই সঙ্গে স্থিতিশীল এবং ইতিবাচক হয়েছে, যা দেশে নতুন পুঁজি সৃষ্টিতে সহায়ক।
রিজার্ভ বৃদ্ধি: বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ বৃদ্ধি পেয়েছে, যা দেশের অর্থনীতিকে আঘাত কমানোর ক্ষেত্রে একটি নিরাপত্তা বলয় হিসেবে কাজ করে। ফলে ব্যাংকগুলো ঝুঁকিমুক্তভাবে ঋণ প্রদান করতে পারে এবং নতুন বিনিয়োগ প্রকল্পে অর্থায়ন বাড়াতে সক্ষম হয়।
কেন্দ্রীয় ব্যাংকের দিকনির্দেশনার প্রভাব: বাংলাদেশ ব্যাংকের নির্দেশনা অনুযায়ী, ব্যাংকগুলো যখন ঋণ প্রদানে সচেতনভাবে অংশ নেবে এবং অগ্রাধিকার খাতে অর্থায়ন করবে, তখন উদ্বৃত্ত অর্থ দ্রুত উৎপাদনমুখী খাতে প্রবাহিত হবে। এটি কেবল ব্যাংকিং খাতকেই স্থিতিশীল করবে না, বরং শিল্প, কৃষি, এসএমই, প্রযুক্তি এবং অবকাঠামোগত উন্নয়নের জন্য নতুন বিনিয়োগ সৃষ্টি করবে। এর ফলে কর্মসংস্থান বৃদ্ধি পাবে, উৎপাদন বাড়বে, এবং দেশের সামগ্রিক অর্থনীতিতে দীর্ঘমেয়াদি ইতিবাচক প্রভাব পড়বে। সংক্ষেপে বলা যায়, বাংলাদেশ ব্যাংকের নীতি-দূরদর্শিতা শুধু বর্তমান অর্থনৈতিক চ্যালেঞ্জ মোকাবিলার জন্য নয়, বরং ভবিষ্যতের স্থিতিশীল ও টেকসই অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি নিশ্চিত করার একটি শক্ত ভিত্তি রচনা করছে।
উপসংহার
বর্তমান পরিস্থিতিকে শুধুমাত্র ‘অলস টাকার সমস্যা’ হিসেবে দেখা উচিত নয়। বাস্তবে এটি অর্থনীতির জন্য একটি গুরুত্বপূর্ণ রূপান্তরের ধাপ। বাংলাদেশ ব্যাংক ধীরে, সুচিন্তিত ও পরিকল্পিতভাবে উদ্বৃত্ত অর্থকে উৎপাদনমুখী খাতে প্রবাহিত করার কৌশল গ্রহণ করেছে। যখন এই অর্থ শিল্প, ব্যবসা এবং অবকাঠামোগত খাতে বিনিয়োগে রূপান্তরিত হবে, তখন নতুন কর্মসংস্থান সৃষ্টি হবে, উদ্যোক্তা ও ব্যবসায়িক উদ্যোগগুলো বৃদ্ধি পাবে, এবং দেশের সামগ্রিক অর্থনীতি আরও শক্তিশালী ও টেকসই হয়ে উঠবে। এই রূপান্তরের মাধ্যমে দেশের আর্থিক ব্যবস্থায় স্থিতিশীলতা বজায় থাকবে, বিনিয়োগকারীর আস্থা পুনরুদ্ধার হবে, এবং দীর্ঘমেয়াদে প্রবৃদ্ধির ধারাকে গতিশীল করা সম্ভব হবে। তাই বর্তমান উদ্বৃত্ত অর্থকে সমস্যারূপে নয়, বরং দেশের উন্নয়নের সম্ভাবনার ভাণ্ডার হিসেবে দেখা উচিৎ।