আন্তর্জাতিক চাপ ও ক্ষুধায় মৃত্যুর ঘটনায় উদ্বেগ বাড়ার পর অবশেষে গাজা উপত্যকায় মানবিক সহায়তার জন্য করিডোর খুলতে যাচ্ছে ইসরায়েল। রোববার এক বিবৃতিতে ইসরায়েল ডিফেন্স ফোর্স (আইডিএফ) জানিয়েছে, গাজায় ত্রাণ সামগ্রী প্রবেশের জন্য তারা কয়েকটি নির্দিষ্ট পথে মানবিক করিডোর খুলে দিচ্ছে। একইসঙ্গে তিনটি এলাকায় প্রতিদিন নির্দিষ্ট সময়ের জন্য ‘সাময়িক যুদ্ধবিরতি’ ঘোষণা করা হয়েছে।
আইডিএফ জানায়, এই সাময়িক বিরতি ও করিডোরের উদ্দেশ্য হলো—জাতিসংঘ ও অন্যান্য আন্তর্জাতিক সংস্থার মাধ্যমে গাজার জনগণের জন্য খাদ্য ও ওষুধ সরবরাহ নিশ্চিত করা। প্রতিদিন সকাল ৬টা থেকে রাত ১১টা (স্থানীয় সময়) পর্যন্ত এসব করিডোর খোলা থাকবে এবং গাজা সিটির পাশাপাশি আল-মাওয়াসি ও দেইর আল-বালাহ এলাকায় সকাল ১০টা থেকে রাত ৮টা পর্যন্ত এই ‘স্থানীয় যুদ্ধবিরতি’ কার্যকর থাকবে।
এর আগে শনিবার ইসরায়েল জানায়, তারা গাজায় আকাশপথে ত্রাণ ফেলেছে। সাতটি প্যাকেটের মধ্যে ছিল ময়দা, চিনি ও টিনজাত খাদ্য। তবে এই ত্রাণ সরবরাহের কার্যকারিতা ও নিরাপত্তা নিয়ে প্রশ্ন তুলেছে জাতিসংঘ ও অন্যান্য মানবাধিকার সংস্থা।
জাতিসংঘের মানবিক প্রধান টম ফ্লেচার এক বিবৃতিতে বলেন, “এই মানবিক বিরতির ঘোষণা স্বাগত জানাই। আমরা আমাদের মাটিতে থাকা দলগুলোর সঙ্গে সমন্বয় করছি যেন এই সুযোগে যত বেশি সম্ভব ক্ষুধার্ত মানুষের কাছে সহায়তা পৌঁছানো যায়।”
তবে এই পরিস্থিতির মধ্যে রোববার মধ্য গাজায় একটি ত্রাণপথে জড়ো হওয়া সাধারণ মানুষের ওপর ইসরায়েলি গুলিতে অন্তত নয়জন নিহত ও ৫৪ জন আহত হয়েছে বলে দাবি করেছে স্থানীয় মেডিকেল সূত্র। নুসাইরাতের আল-আওদা হাসপাতালের মুখপাত্র জানিয়েছেন, আহতদের সেখানে নিয়ে আসা হয়। এই ঘটনায় আইডিএফ-এর মন্তব্য এখনো পাওয়া যায়নি।
এদিকে গাজা সীমান্তের রাফা পয়েন্টে ত্রাণবাহী ট্রাকের দীর্ঘ সারির ছবি সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ছড়িয়ে পড়েছে। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার প্রধান টেড্রোস আধানম গাজায় চলমান পরিস্থিতিকে ‘মানবসৃষ্ট দুর্ভিক্ষ’ হিসেবে উল্লেখ করেছেন।
আইডিএফ দাবি করেছে, গাজায় ত্রাণ বিতরণের দায়িত্ব জাতিসংঘ ও আন্তর্জাতিক ত্রাণ সংস্থার, এবং তারা যেন নিশ্চিত করে যে এসব ত্রাণ যাতে হামাসের হাতে না পড়ে।
রোববারের আগে ইসরায়েল জানায়, তারা আন্তর্জাতিক সংস্থাগুলোর সমন্বয়ে একটি এয়ারড্রপ কার্যক্রম চালিয়েছে, যার নেতৃত্বে ছিল কোঅর্ডিনেশন অব গভর্নমেন্ট অ্যাকটিভিটিজ ইন দ্য টেরিটোরিজ (কোগাট) নামের ইসরায়েলি সামরিক শাখা। সামরিক বাহিনী একটি ভিডিওও প্রকাশ করেছে যেখানে আকাশ থেকে ত্রাণ ফেলার দৃশ্য দেখানো হয়েছে, যদিও এই ভিডিওর সত্যতা স্বাধীনভাবে যাচাই হয়নি।
শনিবার রাতে ইসরায়েল জানায়, তারা গাজার একটি পানিশোধন কেন্দ্রের জন্য আবার বিদ্যুৎ সরবরাহ শুরু করেছে, যা প্রায় ৯ লাখ বাসিন্দাকে সেবা দিতে সক্ষম হবে।
উল্লেখ্য, মার্চের শুরুতে ইসরায়েল গাজায় সব ধরনের সরবরাহ বন্ধ করে দেয় এবং মে মাসে তা সীমিত আকারে কিছু শর্তে আবার চালু করে। যুক্তরাষ্ট্রের সমর্থনে গাজা হিউম্যানিটারিয়ান ফাউন্ডেশন (GHF) নামে একটি সংস্থা গাজায় কার্যক্রম চালাতে শুরু করেছে। তবে সংস্থাটি কার্যক্রম শুরু করার পর থেকে প্রায় প্রতিদিনই ত্রাণ নিতে আসা সাধারণ মানুষ নিহত হওয়ার খবর পাওয়া যাচ্ছে। বিবিসিকে দেয়া সাক্ষাৎকারে একাধিক প্রত্যক্ষদর্শী বলেছেন, এসব ঘটনার পেছনে রয়েছে ইসরায়েলি বাহিনীর গুলি। যদিও ইসরায়েল বলছে, তারা কেবল সতর্কতা হিসেবে গুলি চালায় এবং মৃত্যুর সংখ্যা নিয়ে তারা দ্বিমত পোষণ করে। হামাসকেও তারা দায়ী করছে সংঘাত উসকে দেওয়ার জন্য।
এদিকে, ইসরায়েল সম্প্রতি জর্ডান, সংযুক্ত আরব আমিরাত এবং যুক্তরাজ্যের সমর্থনে গাজায় ত্রাণ এয়ারড্রপ কার্যক্রমে সম্মতি জানিয়েছে। তবে আন্তর্জাতিক ত্রাণ সংস্থাগুলো বলছে, এই ধরনের ত্রাণ সরবরাহ খুবই সীমিত, ব্যয়বহুল এবং বিপজ্জনক।
জাতিসংঘের ফিলিস্তিনি শরণার্থী সংস্থা UNRWA’র প্রধান ফিলিপ লাজারিনি বলেন, “এয়ারড্রপ ব্যয়বহুল, অকার্যকর, এবং পরিকল্পনায় ব্যর্থ হলে ক্ষুধার্ত মানুষের প্রাণহানিও ঘটতে পারে।” তিনি জানান, জর্ডান ও মিশরে UNRWA’র প্রায় ৬ হাজার ট্রাক গাজায় প্রবেশের অপেক্ষায় আছে। তার দাবি, “ইসরায়েলকে অবশ্যই অবরোধ তুলে নিতে হবে, গেট খুলতে হবে এবং মানুষের জন্য নিরাপদ ও মর্যাদাসম্পন্ন সহায়তা নিশ্চিত করতে হবে।”
বিবিসি শনিবার গাজায় কয়েকজন স্থানীয় বাসিন্দার সঙ্গে কথা বলেছে। তারা আশঙ্কা প্রকাশ করেন যে আকাশপথে ত্রাণ ফেলার কার্যক্রম বড় ধরনের দুর্ঘটনা ঘটাতে পারে। গাজার উত্তরে বসবাসরত এক ব্যক্তি বলেন, “এই পদ্ধতি নিরাপদ নয়। গত বছর একইভাবে চালানো ত্রাণ কার্যক্রমে অনেক দুর্ঘটনা ঘটেছিল। কখনো ত্রাণ সরাসরি তাবুতে পড়েছে, ফলে মানুষ আহত বা নিহত হয়েছে।”
ক্ষুধার পাশাপাশি গাজায় দেখা দিয়েছে পানির তীব্র সংকট। এক গৃহবধূ বিবিসিকে বলেন, “আমরা এখন কোনো খাবার বা পানি ছাড়াই বেঁচে আছি। না আছে রুটি, না আছে খাবার, এমনকি একফোঁটা পানিও নেই।”
প্রসঙ্গত, গত বছরের ৭ অক্টোবর হামাসের দক্ষিণ ইসরায়েলে চালানো হামলায় প্রায় ১,২০০ ইসরায়েলি নিহত হন এবং ২৫১ জনকে জিম্মি করা হয়। এর জবাবে ইসরায়েল গাজায় যুদ্ধ ঘোষণা করে। গাজা ভূখণ্ডের স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের (হামাস-চালিত) তথ্য অনুযায়ী, এরপর থেকে এ পর্যন্ত গাজায় ৫৯ হাজারের বেশি মানুষ নিহত হয়েছেন।
সূত্র: বিবিসি