খ. ম জায়েদ হোসেন, নাসির নগর ব্রাহ্মণ বাড়ীয়া : ব্রাহ্মণ বাড়ীয়া জেলাধীন নাসির নগর উপজেলা গোকর্ণ গ্রামে নবাব বাড়ী নামে খ্যাত নবাববাড়ি টি আজ কালের বিবর্তনে হারিয়ে যাচ্ছে। নবাব স্যার শামসুল হুদা শুধু একটা স্থাপত্য নিদর্শন ই নয় এটি এক ঐতিহাসিক স্মৃতিস্তম্ভ, যা বাংলার ইতিহাস, সংস্কৃতি এবং রাজনীতির গুরুত্বপূর্ণ অধ্যায়ের সাক্ষী। এই বাড়ি টি ছিল নবাব স্যার সৈয়দ শামসুল হুদার, যিনি ছিলেন একজন বিশিষ্ট ধর্মীয় পণ্ডিত, রাজনীতিবিদ, শিক্ষানুরাগী, সমাজ সংস্কারক। তাঁর জীবন ও কর্ম কান্ড এই বাড়ীর দেয়ালে, এর প্রতিটি ইটে, প্রতিটি কক্ষে গাঁথা।
নবাব স্যার সৈয়দ শামসুল হুদা ১৮৬৩ সালে নাসিরনগর থানার গোকর্ণ গ্রামে প্রখ্যাত সৈয়দ পরিবারে জনন্মগ্রহণ করেন। হযরত শাহজালালের সাথে আগত ওলীদের অন্যতম সৈয়দ বন্দেগী শাহ ইসমাইল গোকর্ণ গ্রামে বসতি স্থাপন করেন। শামসুল হুদার পিতামহ সৈয়দ শরাফতুল্লাহ আঠার শতকের চল্লিশের দশকে চট্টগ্রামে বিচার বিভাগে একজন পদস্থ সরকারি কর্মচারি ছিলেন। তাঁর পিতা শাহ সৈয়দ রিয়াযাতুল্লাহ ব্রাহ্মণবাড়িয়া দেওয়ানী আদালতে ওকালতি করতেন। পরবর্তীতে তিনি নবাব আবদুল লতীফ কর্তৃক প্রতিষ্ঠিত
ফার্সী ভাষায় প্রকাশিত সাপ্তাহিক ‘দূরবীন’ (কলিকাতা) সম্পাদক হিসেবে যোগ দেন এবং ১৮৬৪ থেকে ১৮৬৫ সাল পর্যন্ত নিয়োজিত ছিলেন। তাছাড়া তিনি ফার্সী ভাষায় একজন কবিও ছিলেন।
নবাব স্যার সৈয়দ শামসুল হুদা ১৮৮৪ সালে কলকাতা প্রেসিডেন্সী কলেজ থেকে আই. এ. পাশ করেন এবং ১৮৮৬ সালে বি. এ. পাশ করেন। ওকালতি পড়ার সময় তিনি প্রাইভেট প্রার্থী রূপে ফার্সীতে এম. এ. পাশ করেন। তাঁর কর্মজীবন শুরু করেন কলকাতা মাদ্রাসার আরবী ফার্সী অধ্যাপক রূপে। ওকালতি পাশ করার পর তিনি ১৮৮৭ সালে কলকাতা হাইকোর্টে আইন ব্যবসা শুরু করেন। পরবর্তীতে তিনি কলকাতা হাই কোর্টের বিচারপতি হন। স্যার সৈয়দ আমীর আলীর পর তিনি ছিলেন কলকাতা হাইকোর্টের দ্বিতীয় মুসলিম বিচারপতি। ১৮৯৪ সালে তিনি কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের ফেলো নির্বাচিত হন। শামসুল হুদাকে ১৯০২ সালে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের ‘ঠাকুর আইন অধ্যাপক’ নিযুক্ত করা হয়। অধ্যাপ- নার সময় দন্ড বিধি আইন সম্পর্কে তিনি যে সব বক্তৃতা দেন সেগুলি পরবর্তীতে ‘বৃটিশ ভারতীয় দন্ডবিধি আইন’ নামে ইংরেজি ভাষায় প্রকাশিত হয় (১৯১৯ খ্রি.)। সে সময় থেকে তাঁর গভীর আইন অভিজ্ঞতার খ্যাতি সমগ্র ভারত ব্যাপী ছড়িয়ে পড়ে।
১৯১২ সালে লর্ড কারমাইকেল বঙ্গ প্রেসিডেন্সীর গভর্নর নিযুক্ত হন। লর্ড কারমাইকেল তাঁর যে এক্সিকিউটিভ কাউন্সিল গঠন করেন তিন সদস্য নিয়ে তাঁরা হলেন: ১। অনার্যাবল জাসটিস নবাব স্যার সৈয়দ শামসুল হুদা কে. সি. আই. ই. ২। অনার্যাবল স্যার এন, ডি, বিটসন বেল কেটি, সি ও ৩। অনার্যাবল স্যার পি. সি, লায়ন, কেটি। এঐ কাউন্সিলে শামসুল হুদা সর্বপ্রথম ভারতীয় সদস্য। এর পূর্বে কেবল মাত্র বৃটিশ অধিবাসী এ কাউন্সিলের সদস্য হতেন। ঐ কাউন্সিলে শামসুল হুদা স্বায়ত্ব শাসন ও শিক্ষা ক্ষেত্রে ও নারী শিক্ষা ক্ষেত্রে অসামান্য অবদান রেখে গেছেন। বিভিন্ন ক্ষেত্রে তাঁর অবদানের জন্য তাঁকে ১৯১৩ সালে নবাব এবং ১৯১৬ সালে কে. সি. আই. ই অর্থাৎ ‘নাইট কমান্ডার অব ইন্ডিয়ান এমপায়ার’ খেতাবে ভূষিত করে বৃটিশ সরকার। এটি একটি দুর্লভ সম্মান জনক খেতাব। ১৯২১ সালে তিনি বেঙ্গল লেজিসলেটিভ কাউন্সিলের প্রেসিডেন্ট পদে যোগদান করেন। তিনিই ছিলেন ব্যবস্থাপক সভার প্রথম ভারতীয় প্রেসিডেন্ট অর্থাৎ বর্তমানে যাকে স্পীকার বলা হয়। ১৯১২ সালে শামসুল হুদা সর্বভারতীয় মুসলিম লীগের সভাপতি নির্বাচিত হয়েছিলেন।
১৯২১ সালে বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠিত হলে তৎকালীন বঙ্গীয় প্রেসিডেন্সীর গভর্নর লর্ড রোনাল্ডশে শামসুল হুদাকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যায়ের আজীবন সদস্য করেন। উল্লেল্লখ্য যে, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে তিন সদস্য বিশিষ্ট একটি কমিটি গঠন করা হয়েছিল। এর একজন ছিলেন শামসুল হুদা এবং অপর দু’জন সদস্য ছিলেন ইংরেজ। এখানে আরো উড়োখ যে, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠিত হবার পর ভারত খ্যাত আলীগড় মুসলিম বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রফেসর এ. এফ. রহমান শামসুল হুদাকে একটি চিঠি লিখেছিলেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে তাঁকে প্রফেসর হিসেবে নিয়োগদানে যেন গভর্নর লর্ড রোনাল্ডশেকে সুপারিশ করেন। শামসুল হুদা তাঁর জন্য সুপারিশ করেছিলেন এবং তিনি প্রফেসর হিসেবে চাকরি পেয়েছিলেন। পরবর্তীতে এ. এফ, রহমান স্যার উপাধি প্রাপ্ত হন এবং ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ভাইস চ্যান্সেলার হয়েছিলেন। ইংরেজরা শামসুল হুদাকে ভারতের কাল রত্ন বলতেন।
ভারতের প্রথম রাষ্ট্রপতি ড. রাজেন্দ্র প্রসাদ একসময় শামসুল হুদার আর্টিকল ক্লার্ক ছিলেন। নবাব শামসুল হুদা নিজ আম গোকর্ণে ‘গোকর্ণ ওলীউল্লাহ উচ্চ বিদ্যালয়’ স্থাপন করেন এবং ব্রাহ্মণবাড়িয়া শহরে অন্নদা সরকারী উচ্চ বিদ্যালয়ের পুকুরের উত্তর তীরে শহরের বিভিন্ন উচ্চ বিদ্যালয়ের মুসলিম ছাত্রদের জন্য স্ত্রীর নামে “আসমাতুননিসা” ছাত্রাবাস নির্মাণ করেন। তাঁর প্রচেষ্টায় শহরের ঐতিহ্যবাহী জজ হাই ইংলিশ স্কুল (বর্তমানে নিয়াজ মুহম্মদ উচ্চ বিদ্যালয়) ১৯১৯ সালে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃক স্থায়ী স্বীকৃতি লাভ করে।
ভারত খ্যাত রাজনীতিবিদ নবাব স্যার সৈয়দ শামসুল হুদা কে. সি.আই. ই ১৯২২ সালের ৭ অক্টোবর ইন্তেকাল করেন।