ব্রেক্সিট পরবর্তী সময়ে প্রথম ইউরোপীয় নেতা হিসেবে যুক্তরাজ্যে রাষ্ট্রীয় সফরে গিয়েছেন ফ্রান্সের প্রেসিডেন্ট ইমানুয়েল ম্যাক্রোঁ। মঙ্গলবার (৯ জুলাই) ব্রিটিশ পার্লামেন্টে বিরল ভাষণে তিনি গাজায় যুদ্ধবিরতি এবং ইউক্রেনের প্রতি সমর্থন অব্যাহত রাখার পাশাপাশি ফিলিস্তিন রাষ্ট্র স্বীকৃতির বিষয়ে যুক্তরাজ্যের সমর্থন চেয়েছেন।
তিন দিনের এই সফর অনুষ্ঠিত হচ্ছে রাজা চার্লস তৃতীয়ের আমন্ত্রণে। সফরের শুরুতে রাজপরিবারের সদস্য প্রিন্স উইলিয়াম ও প্রিন্সেস ক্যাথরিন ম্যাক্রোঁকে স্বাগত জানান। পরে রাজকীয় শোভাযাত্রায় ঘোড়ার গাড়িতে করে তাঁরা উইন্ডসর ক্যাসেলে যান।
এরপর ব্রিটিশ পার্লামেন্টে দেওয়া ভাষণে ম্যাক্রোঁ বলেন, ফ্রান্স ও যুক্তরাজ্যকে একসঙ্গে কাজ করতে হবে ইউরোপের প্রতিরক্ষা, অভিবাসন, জলবায়ু এবং বাণিজ্য খাতে। তার ভাষায়, “যুক্তরাজ্য ও ফ্রান্সকে আবারও প্রমাণ করতে হবে যে, আমাদের মৈত্রী বিশ্বের জন্য কতটা গুরুত্বপূর্ণ হতে পারে। আমাদের সময়ের চ্যালেঞ্জ মোকাবিলার একমাত্র উপায়— একসঙ্গে কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে এগিয়ে চলা।”
ইউক্রেন প্রসঙ্গে ম্যাক্রোঁ বলেন, “রাশিয়ার আগ্রাসনের বিরুদ্ধে ইউরোপ কখনোই ইউক্রেনকে একা ছেড়ে দেবে না।” পাশাপাশি গাজায় অব্যাহত সহিংসতার নিন্দা জানিয়ে তিনি নিরবর্তনীয় যুদ্ধবিরতির আহ্বান জানান।
ম্যাক্রোঁ বলেন, “গাজা ধ্বংসস্তূপে পরিণত হয়েছে, পশ্চিম তীরেও প্রতিদিন হামলার শিকার হচ্ছে মানুষ। এই প্রেক্ষাপটে ফিলিস্তিন রাষ্ট্রের স্বীকৃতি আরও ঝুঁকির মধ্যে পড়েছে।” তিনি স্পষ্ট করে বলেন, “দুই রাষ্ট্রভিত্তিক সমাধান এবং ফিলিস্তিন রাষ্ট্রের স্বীকৃতিই হলো স্থায়ী শান্তি ও আঞ্চলিক স্থিতিশীলতার একমাত্র পথ।”
ফরাসি প্রেসিডেন্ট পশ্চিমা জগৎকে যুক্তরাষ্ট্র ও চীনের প্রতি ‘অতিরিক্ত নির্ভরতা’ থেকে বের হয়ে আসার আহ্বান জানান। তিনি বলেন, “আমাদের অর্থনীতি ও সমাজকে এই দ্বৈত নির্ভরতা থেকে ‘ডি-রিস্ক’ করতে হবে।”
ম্যাক্রোঁ পারস্পরিক সম্পর্ক উন্নয়নের সম্ভাবনার কথা উল্লেখ করে বলেন, উভয় দেশের শিক্ষার্থী, গবেষক ও শিল্পীদের জন্য বসবাস ও কাজের সুযোগ সহজ করতে হবে। তিনি কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা এবং শিশুদের অনলাইন সুরক্ষা ইস্যুতেও যৌথভাবে কাজ করার প্রস্তাব দেন।
এই ভাষণ যুক্তরাজ্যের নতুন প্রধানমন্ত্রী কেয়ার স্টারমারের নেতৃত্বাধীন লেবার পার্টির ইউরোপবান্ধব নীতির প্রতিফলন হিসেবেও বিবেচিত হচ্ছে, যা ব্রেক্সিট পরবর্তী সম্পর্ক পুনর্গঠনের একটি ইঙ্গিত।
মঙ্গলবার রাতেই উইন্ডসর ক্যাসেলে রাজা চার্লস ম্যাক্রোঁর সম্মানে এক জাঁকজমকপূর্ণ নৈশভোজের আয়োজন করেন। এ আয়োজনে উপস্থিত ছিলেন প্রায় ১৬০ জন বিশিষ্ট ব্যক্তি, যাঁদের মধ্যে ছিলেন মিক জ্যাগার ও এলটন জনের মতো তারকাও।
রাজা চার্লস তাঁর বক্তব্যে ফ্রান্স-যুক্তরাজ্যের ঐতিহাসিক ‘Entente Cordiale’ সম্পর্ককে ‘Entente Amicale’ হিসেবে আখ্যায়িত করেন। তিনি বলেন, “আজ আমরা এই ঐতিহাসিক প্রাসাদে বসে আমাদের সম্পর্কের নতুন অধ্যায়ের সূচনা করছি— শুধুমাত্র হৃদ্যতা নয়, এখন এটি হবে বন্ধুত্বের সম্পর্ক।”
সফরের অংশ হিসেবে ফরাসি বিদ্যুৎ সংস্থা EDF যুক্তরাজ্যের পূর্বাঞ্চলে একটি পারমাণবিক বিদ্যুৎ প্রকল্পে ১.১ বিলিয়ন পাউন্ড (১.৫ বিলিয়ন ডলার) বিনিয়োগের ঘোষণা দিয়েছে।
এছাড়া সাংস্কৃতিক বিনিময়ের অংশ হিসেবে ১১ শতকের ঐতিহাসিক ‘বায়ো টেপেস্ট্রি’ ফ্রান্স থেকে যুক্তরাজ্যে ফিরিয়ে আনা হবে ৯০০ বছরেরও বেশি সময় পর। বিনিময়ে ব্রিটিশ যাদুঘরের অ্যাংলো-স্যাক্সন ও ভাইকিং যুগের কিছু মূল্যবান নিদর্শন প্যারিসে পাঠানো হবে।
বুধবার (১০ জুলাই) দুই নেতার মধ্যে দ্বিপাক্ষিক বৈঠক অনুষ্ঠিত হবে। আলোচনায় থাকবে অভিবাসন, প্রতিরক্ষা ও বিনিয়োগ বিষয়ক ইস্যু। বিশেষ করে ইংলিশ চ্যানেল পাড়ি দিয়ে ক্ষুদ্র নৌকায় যুক্তরাজ্যে অনুপ্রবেশ রোধে উভয় দেশ কৌশল নির্ধারণে আগ্রহী।
স্টারমার চাচ্ছেন, ফ্রান্সের সঙ্গে এমন একটি চুক্তি হোক যার আওতায় যুক্তরাজ্য থেকে এক অনুপ্রবেশকারীকে ফেরত পাঠালে ফ্রান্স এক বৈধ আশ্রয়প্রার্থীকে গ্রহণ করবে। যদিও এখনো পর্যন্ত ফ্রান্স এমন কোনো দ্বিপাক্ষিক চুক্তি করতে রাজি হয়নি। তাদের মত, এই বিষয়ে যুক্তরাজ্যকে পুরো ইউরোপীয় ইউনিয়নের সঙ্গে আলোচনা করতে হবে।
বৃহস্পতিবার (১১ জুলাই) ম্যাক্রোঁ ও স্টারমার ইউক্রেন নিয়ে গঠিত আন্তর্জাতিক জোটের এক বৈঠকে ভার্চুয়ালি অংশ নেবেন। সেখানে ইউক্রেনের প্রেসিডেন্ট ভলোদিমির জেলেনস্কি, জার্মান চ্যান্সেলর ফ্রিডরিখ মার্জ এবং ইতালির প্রধানমন্ত্রী জর্জিয়া মেলোনিও উপস্থিত থাকবেন।
এই বৈঠকে ইউক্রেনকে আরও সমর্থন ও রাশিয়ার ওপর চাপ বাড়ানো নিয়ে আলোচনা হবে বলে নিশ্চিত করেছে স্টারমারের কার্যালয়।
সূত্র: আল জাজিরা