ইরানকে লক্ষ্য করে ইসরায়েলের চলমান হামলার ঘটনায় সাংহাই সহযোগিতা সংস্থা (এসসিও) যখন তীব্র নিন্দা জানিয়েছে, তখন ভারত নিজেদের অবস্থান থেকে কিছুটা দূরত্ব তৈরি করেছে। বিশ্লেষকরা বলছেন, এর ফলে ইউরেশীয় অঞ্চলের গুরুত্বপূর্ণ রাজনৈতিক ও নিরাপত্তা জোটে ভাঙনের সম্ভাবনা তৈরি হয়েছে।
বিশ্ব নেতারা ইরান-ইসরায়েল বিরোধে বারবার উত্তেজনা প্রশমনের আহ্বান জানিয়ে এলেও, শুক্রবার থেকে ইসরায়েলের নতুন করে ইরানের সামরিক ও পারমাণবিক স্থাপনায় হামলা পরিস্থিতিকে আরও জটিল করে তুলেছে।
২০২৪ সালে এ নিয়ে ইরান ও ইসরায়েলের মধ্যে তৃতীয় দফা সরাসরি সামরিক সংঘর্ষ চলছে। আগের দুই দফার মতো এবারও ইসরায়েলের হামলার জবাবে ইরান পাল্টা ব্যবস্থা নিয়েছে।
ইরানি কর্তৃপক্ষ জানিয়েছে, শুক্রবার থেকে শুরু হওয়া ইসরায়েলি হামলাগুলো তেহরানসহ বহু শহরের আবাসিক ও সামরিক এলাকাকে লক্ষ্য করে চালানো হয়েছে। এতে এখন পর্যন্ত অন্তত ৮০ জন নিহত হয়েছেন, যাদের মধ্যে সাধারণ নাগরিক ছাড়াও বেশ কয়েকজন পারমাণবিক বিজ্ঞানী, বিশ্ববিদ্যালয় অধ্যাপক এবং ইসলামি বিপ্লবী গার্ড বাহিনীর (আইআরজিসি) শীর্ষ পর্যায়ের কর্মকর্তারা রয়েছেন।
শনিবার ইসরায়েল আরও হামলা চালিয়েছে ইরানের তেল শোধনাগার, বিদ্যুৎকেন্দ্র এবং জ্বালানি মজুদাগারে। এর জবাবে তেহরান শত শত ক্ষেপণাস্ত্র ও ড্রোন ছুড়েছে ইসরায়েলের তেল আবিব ও হাইফা শহরে, যাতে কমপক্ষে ১৩ জন নিহত এবং বহু মানুষ আহত হয়েছেন। একইসাথে ইরান যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে চলমান পারমাণবিক আলোচনা স্থগিত করেছে।
তাহলে ভারত কেন এসসিও’র বিবৃতি থেকে সরে দাঁড়াল? ইসরায়েলের পক্ষ নিচ্ছে ভারত?
এসসিও কী বলেছে?
২০০১ সালে গঠিত সাংহাই সহযোগিতা সংস্থা (SCO) একটি রাজনৈতিক ও নিরাপত্তাভিত্তিক জোট, যার সদস্য রাষ্ট্রগুলো হলো: চীন, রাশিয়া, ভারত, পাকিস্তান, ইরান, কাজাখস্তান, কিরগিজস্তান, তাজিকিস্তান, উজবেকিস্তান এবং বেলারুশ। ২০২৩ সালে ভারতের সভাপতিত্বে ইরান এই জোটে যোগ দেয়।
শনিবার চীনের নেতৃত্বাধীন এসসিও এক বিবৃতিতে জানায়, ইরান-ইসরায়েল উত্তেজনার ঘটনায় তারা গভীর উদ্বেগ প্রকাশ করছে এবং ইরানের ভূখণ্ডে ইসরায়েলের সামরিক হামলার ‘তীব্র নিন্দা’ জানায়।
বিবৃতিতে বলা হয়, ইসরায়েলের এই আগ্রাসী কর্মকাণ্ড, বিশেষ করে বেসামরিক লক্ষ্যবস্তু, জ্বালানি ও পরিবহন অবকাঠামোতে হামলা আন্তর্জাতিক আইন ও জাতিসংঘ সনদের সরাসরি লঙ্ঘন এবং এতে বেসামরিক প্রাণহানি ঘটেছে।
এছাড়া বিবৃতিতে উল্লেখ করা হয়, “এই হামলা ইরানের সার্বভৌমত্বের উপর হস্তক্ষেপ, আঞ্চলিক ও আন্তর্জাতিক নিরাপত্তার জন্য হুমকি এবং বৈশ্বিক শান্তি ও স্থিতিশীলতার জন্য গুরুতর ঝুঁকি সৃষ্টি করছে।” বিবৃতিতে ইরান সরকার ও জনগণের প্রতি গভীর সমবেদনা জানানো হয়।
এসসিও আরও জানায়, তারা ইরানের পারমাণবিক কর্মসূচি ঘিরে যেকোনো উত্তেজনা শুধুমাত্র শান্তিপূর্ণ, রাজনৈতিক ও কূটনৈতিক উপায়ে সমাধানের পক্ষেই অবস্থান নেয়।
ভারতের ‘সংবেদনশীল ভারসাম্য রক্ষা’
ইসরায়েলের তেহরানে প্রথম হামলার পর ভারতের পররাষ্ট্র মন্ত্রী এস. জয়শঙ্কর ইরানের পররাষ্ট্রমন্ত্রী আব্বাস আরাঘচির সঙ্গে ফোনে কথা বলেন। তিনি তখন ‘আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের গভীর উদ্বেগ’ প্রকাশ করেন এবং দ্রুত কূটনৈতিক পথে উত্তেজনা নিরসনের আহ্বান জানান।
ভারতের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় এক বিবৃতিতে জানায়, তারা পরিস্থিতির ওপর ‘ঘনিষ্ঠ নজর’ রাখছে, বিশেষ করে পারমাণবিক স্থাপনায় হামলার বিষয়টি গভীর উদ্বেগের সঙ্গে পর্যবেক্ষণ করছে। বিবৃতিতে বলা হয়, “ভারত উভয় দেশের সঙ্গে ঘনিষ্ঠ ও বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক বজায় রাখে এবং প্রয়োজনে যেকোনো ধরনের সহায়তা দিতে প্রস্তুত।”
ম্যাসাচুসেটস-আমহার্স্ট বিশ্ববিদ্যালয়ের গবেষক শ্যান্থি ডি’সুজা আল জাজিরাকে বলেন, “অন্য এসসিও সদস্যদের তুলনায় ভারতের অবস্থান আলাদা। কারণ, ভারতের একদিকে ইসরায়েলের সঙ্গে প্রতিরক্ষা সম্পর্ক এবং অন্যদিকে ইরানের সঙ্গে অর্থনৈতিক অংশীদারিত্ব রয়েছে।”
ভারত ইসরায়েলের সবচেয়ে বড় অস্ত্র ক্রেতা, এবং ২০২৪ সালে গাজায় চলমান যুদ্ধে ভারতীয় অস্ত্র নির্মাতা প্রতিষ্ঠানগুলো ইসরায়েলকে রকেট ও বিস্ফোরক সরবরাহ করেছে। অন্যদিকে, ইরানের চাবাহার বন্দরকে কেন্দ্র করে ভারত মধ্য ও দক্ষিণ এশিয়ায় রপ্তানি বাড়ানোর পথ তৈরি করছে।
ডি’সুজা বলেন, “সাম্প্রতিক ইরান-ইসরায়েল সংঘর্ষে ভারত একটি সংবেদনশীল ভারসাম্য বজায় রাখছে।”
এসসিও’র বিবৃতির নিন্দা থেকে নিজেকে বিরত রাখার পর ভারত জানায়, বিবৃতিটির আলোচনায় তারা অংশ নেয়নি।
ভারতের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় জানায়, “এসসিও সদস্যদের কাছে ভারতের অবস্থান আগেই জানানো হয়েছিল,” যেখানে ভারতের বিবৃতির কথা উল্লেখ করা হয়।
ভারত কি ইসরায়েলকে সমর্থন দিচ্ছে?
সরাসরি নয়। তবে এসসিও’র বিবৃতি থেকে সরে এসে ভারত জোটের অবস্থানকে দুর্বল করেছে।
এর একদিন আগে জাতিসংঘ সাধারণ পরিষদে গাজায় ‘তাৎক্ষণিক, নিঃশর্ত ও স্থায়ী যুদ্ধবিরতি’ দাবিকৃত প্রস্তাবে ভোটদানে বিরত ছিল ভারত।
নয়াদিল্লিভিত্তিক অবজারভার রিসার্চ ফাউন্ডেশনের কৌশলগত বিশ্লেষক কবীর তানেজা বলেন, জাতিসংঘে ভারতের ভোটদানে বিরত থাকা বেশ অবাক করা। তিনি বলেন, সম্ভবত যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে সুসম্পর্ক রক্ষার প্রয়োজনে ভারত এমনটা করেছে। কারণ, যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে ভারতের একটি বাণিজ্য চুক্তি প্রায় চূড়ান্ত পর্যায়ে রয়েছে এবং প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প আগামী জুলাই থেকে ভারতীয় পণ্যে ২৭ শতাংশ শুল্ক আরোপের হুমকি দিয়েছেন।
তিনি আরও বলেন, এসসিও’র বিবৃতির নিন্দা থেকে ভারত সরে যাওয়ায় এটি প্রমাণ করে যে, ভারতের অবস্থান জোটের মধ্যে একপ্রকার ব্যতিক্রম। তিনি বলেন, “চীন ও রাশিয়া যেখানে ইরানের ঘনিষ্ঠ, সেখানে যুক্তরাষ্ট্র ও ইসরায়েলের সঙ্গে ভারতের সম্পর্ক থাকায়, এসসিও’র বিবৃতির ভাষায় ভারত সম্মতি দিতে পারেনি।”
ভারতের কৌশলগত লক্ষ্য কি ক্ষতিগ্রস্ত হবে?
দক্ষিণ এশিয়া বিষয়ক বিশ্লেষক মাইকেল কুগেলম্যান বলেন, ইরান ও ইসরায়েল, রাশিয়া ও যুক্তরাষ্ট্র, সৌদি আরব ও ইরান – এই ধরনের প্রতিদ্বন্দ্বী সম্পর্কের মধ্যেও ভারসাম্য রক্ষা করতে ভারত বরাবরই অভ্যস্ত।
ইরানের ওপর যুক্তরাষ্ট্রের চাপ বাড়লে ভারতের স্বার্থ ক্ষতিগ্রস্ত হতে পারে। ২০১৭ সালে ট্রাম্প যখন ইরান পরমাণু চুক্তি থেকে বেরিয়ে আসেন, তখন ভারত ইরান থেকে সবচেয়ে বেশি তেল আমদানিকারক দেশগুলোর একটি ছিল।
২০২৫ সালে দ্বিতীয় মেয়াদে ক্ষমতায় ফিরে ট্রাম্প আবারও ইরানের ওপর নিষেধাজ্ঞা জোরদার করেছেন এবং চাবাহার বন্দরের প্রকল্পেও ছাড়পত্র বাতিল করেন, যা ভারতের জন্য কৌশলগতভাবে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।
এই বন্দর ভারতকে পাকিস্তানকে বাইপাস করে আফগানিস্তান ও মধ্য এশিয়ার সঙ্গে বাণিজ্য করতে সাহায্য করে। প্রথম ট্রাম্প প্রশাসনেই ভারত এ প্রকল্পে কাজের জন্য মার্কিন নিষেধাজ্ঞা থেকে ছাড়পত্র পেয়েছিল।
তবে ভারতের স্বার্থ শুধু চাবাহার বন্দরেই সীমাবদ্ধ নয়। কবীর তানেজা বলেন, আফগানিস্তান ও মধ্য এশিয়ায় প্রবেশাধিকার, কৌশলগত অবস্থান এবং আঞ্চলিক প্রভাব বিস্তারের জন্য ভারত ইরানকে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ মনে করে।
অন্যদিকে কুগেলম্যান বলেন, “ইসরায়েল যেভাবে কড়া সামরিক পদক্ষেপে নিজের নিরাপত্তা নিশ্চিত করে, তা ভারত অনেকটা প্রশংসার চোখেই দেখে।”
তবে তিনি সতর্ক করে দিয়ে বলেন, “ভারতের উচিত হবে নিরপেক্ষতা বজায় রাখা। কারণ, মধ্যপ্রাচ্য শুধু ইসরায়েল নয়, বরং ভারতের জন্য এক গুরুত্বপূর্ণ বাণিজ্যিক, বিনিয়োগ এবং প্রবাসী জনশক্তির উৎস।”