Site icon আজকের কাগজ

ইসলামি ব্যাংকগুলো একীভূতকরণের প্রস্তাব: সমাধান নাকি নতুন সংকটের সূচনা?

ইসলামি ব্যাংকগুলো একীভূতকরণের প্রস্তাব: সমাধান নাকি নতুন সংকটের সূচনা?

বাংলাদেশের ব্যাংকিং খাতে বর্তমানে ইসলামি ব্যাংকগুলোর প্রসার ও জনপ্রিয়তা উল্লেখযোগ্যভাবে বেড়েছে। তবে সম্প্রতি এসব ব্যাংককে নিয়ে নতুন করে আলোচনার ঝড় উঠেছে বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর ড. আহসান এইচ মনসুরের এক মন্তব্য ঘিরে। তিনি বলেছেন, দেশের ১০টি ইসলামি ব্যাংককে একীভূত করে দুটি শক্তিশালী ব্যাংক গঠন করার পরিকল্পনা গ্রহণ করা হতে পারে। তার এই মন্তব্য ব্যাংকিং খাতের বিশেষজ্ঞ, সংশ্লিষ্ট ব্যাংকার এবং বিনিয়োগকারীদের মধ্যে মিশ্র প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি করেছে।

ইসলামি ব্যাংকিং খাতের বর্তমান অবস্থা

বর্তমানে দেশে ১০টি পূর্ণাঙ্গ ইসলামি ব্যাংক রয়েছে। এসব ব্যাংকের সম্মিলিত আমানতের পরিমাণ প্রায় ৩ লাখ ৮৫ হাজার কোটি টাকা এবং বিনিয়োগ ছাড়িয়েছে ৪ লাখ ৮৬ হাজার কোটি টাকা। সাধারণ গ্রাহকের আস্থা এবং শরিয়াহভিত্তিক সেবা গ্রহণের আগ্রহের কারণে এসব ব্যাংকের সম্প্রসারণ দৃশ্যমান। তবে কিছু ব্যাংকের বিরুদ্ধে অনিয়ম, প্রভাবশালী গোষ্ঠীর নিয়ন্ত্রণ এবং সুশাসনের অভাবের অভিযোগ দীর্ঘদিন ধরে চলে আসছে।

বিশেষ করে এস আলম গ্রুপের নিয়ন্ত্রিত ইসলামী ব্যাংক বাংলাদেশ, সোশ্যাল ইসলামী ব্যাংক এবং ফার্স্ট সিকিউরিটি ইসলামী ব্যাংকের কার্যক্রম ঘিরে নানা বিতর্ক তৈরি হয়েছে। সরকার পরিবর্তনের পর বাংলাদেশ ব্যাংক এসব ব্যাংকের পরিচালনা পর্ষদ থেকে এস আলম গ্রুপের সদস্যদের অপসারণ করে। এরপর থেকে সংশ্লিষ্ট ব্যাংকগুলো ঘুরে দাঁড়ানোর চেষ্টা করছে। তবে শাহজালাল ইসলামী ব্যাংক, আল-আরাফাহ্ ইসলামী ব্যাংক ও স্ট্যান্ডার্ড ব্যাংকের অবস্থান তুলনামূলকভাবে মজবুত।

একীভূতকরণ পরিকল্পনার পেছনের প্রেক্ষাপট

সম্প্রতি বাংলাদেশ ব্যাংক ‘ব্যাংক রেজুলেশন অর্ডিন্যান্স, ২০২৫’ অনুমোদন দিয়েছে। এই অর্ডিন্যান্স কার্যকর হলে আর্থিকভাবে দুর্বল ব্যাংকগুলোকে একীভূতকরণ বা অবসায়নের আওতায় আনা যাবে। এরই প্রেক্ষিতে গভর্নরের বক্তব্যে এমন সম্ভাবনার ইঙ্গিত পাওয়া যায় যে, সরকার দুর্বল ইসলামি ব্যাংকগুলোকে একীভূত করে দুটি বড় ও সুসংগঠিত ব্যাংকে রূপান্তরের পরিকল্পনা করছে।

বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব ব্যাংক ম্যানেজমেন্টের (বিআইবিএম) বার্ষিক ব্যাংকিং সম্মেলনে গভর্নর বলেন, “বর্তমানে দেশে একাধিক ছোট ও সমস্যাগ্রস্ত ইসলামি ব্যাংক রয়েছে। তাদের একীভূত করে দুটি শক্তিশালী ব্যাংক গঠন করা হবে।” তিনি আরও জানান, ইসলামি ব্যাংকগুলোর জন্য আলাদা আইন ও তদারকি কাঠামো গড়ে তোলার উদ্যোগও নেওয়া হবে।

বিশেষজ্ঞদের উদ্বেগ ও পরামর্শ

তবে ব্যাংক খাতের বিশেষজ্ঞরা বলছেন, একসাথে ১০টি ব্যাংককে একীভূত করার প্রক্রিয়া অত্যন্ত জটিল এবং ঝুঁকিপূর্ণ। বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক প্রধান অর্থনীতিবিদ ড. মুস্তাফা কে মুজেরি বলেন, “ব্যাংকের সংখ্যা কমানোর চেয়ে বেশি জরুরি হচ্ছে সুশাসন প্রতিষ্ঠা এবং আর্থিক ভিত্তি মজবুত করা।”

গ্লোবাল ইসলামী ব্যাংকের চেয়ারম্যান মোহাম্মদ নুরুল আমিন বলেন, “দুর্বল ব্যাংকগুলোকে প্রথমে আর্থিকভাবে সক্ষম করে তুলতে হবে। এরপর একীভূতকরণ বিবেচনায় নেওয়া যেতে পারে।”

তিনটি ইসলামি ব্যাংকের প্রধান নির্বাহীর মতে, কিছু ব্যাংকের মধ্যে আংশিক একীভূতকরণ সম্ভব হলেও, একযোগে ১০টি ব্যাংক একত্রিত করা বাস্তবতা ও ঝুঁকি বিবেচনায় সম্ভবপর নয়।

সম্ভাব্য ঝুঁকি ও চ্যালেঞ্জ

বাংলাদেশে ব্যাংক খাত দীর্ঘদিন ধরে অনিয়ম, দুর্বল তদারকি, এবং রাজনৈতিক হস্তক্ষেপে ক্ষতিগ্রস্ত। কিছু ব্যাংক কার্যত ধসে পড়ার অবস্থায় রয়েছে, আর্থিক লেনদেন চালাতে হচ্ছে অন্য ব্যাংকের ধার করে। ইসলামি ব্যাংকগুলোর ক্ষেত্রেও একই সমস্যা বিদ্যমান, বিশেষ করে যারা বিভিন্ন প্রভাবশালী গোষ্ঠীর নিয়ন্ত্রণে ছিল।

বিশেষজ্ঞরা বলছেন, যদি একীভূতকরণের উদ্যোগ যথাযথ মূল্যায়ন ছাড়া এবং রাজনৈতিক বিবেচনায় পরিচালিত হয়, তবে এটি ব্যাংকিং খাতের জন্য বিপজ্জনক হয়ে উঠতে পারে। আন্তর্জাতিক নিরীক্ষা ও সম্পদের মান যাচাইয়ের মতো প্রক্রিয়া সম্পন্ন হওয়ার পরই কেবল এমন উদ্যোগ গ্রহণ করা যেতে পারে।

বাংলাদেশ ব্যাংকের অবস্থান

এ বিষয়ে বাংলাদেশ ব্যাংকের মুখপাত্র আরিফ হোসেন খান স্পষ্ট করে বলেছেন, “আমরা আপাতত কোনও একীভূতকরণের কার্যক্রম শুরু করছি না। ব্যাংক রেজুলেশন অর্ডিন্যান্স ২০২৫ জারি হওয়ার পরই প্রয়োজনে সিদ্ধান্ত নেওয়া হবে।”

তিনি আরও জানান, ব্যাংক খাতে শৃঙ্খলা ও সুশাসন প্রতিষ্ঠার জন্য এই অধ্যাদেশ গুরুত্বপূর্ণ হবে এবং কেন্দ্রীয় ব্যাংককে আরও কার্যকরভাবে পদক্ষেপ নিতে সক্ষম করবে।

ইসলামি ব্যাংকগুলোর একীভূতকরণ নিয়ে আলোচনা এখন নীতিনির্ধারকদের টেবিলে থাকলেও এর বাস্তবায়ন নিয়ে রয়েছে নানা প্রশ্ন। ব্যাংকিং খাতে দীর্ঘদিন ধরে চলে আসা দুর্বল ব্যবস্থাপনা ও প্রভাবশালী গোষ্ঠীর প্রভাব দূর না করে কেবলমাত্র একীভূতকরণের পথে হাঁটলে, তা সমস্যার সমাধানের পরিবর্তে নতুন সংকট তৈরি করতে পারে।
সেই প্রেক্ষাপটে সরকারের উচিত হবে একীভূতকরণের আগেই সুশাসন, জবাবদিহি ও স্বচ্ছতা নিশ্চিত করে একটি কার্যকর ভিত্তি তৈরি করা। নইলে এই উদ্যোগ শুধু রাজনৈতিক প্রদর্শনেই সীমাবদ্ধ থেকে যাবে, যার পরিণতি হতে পারে আরও ভয়াবহ আর্থিক অস্থিরতা।

Exit mobile version