বাউন্ডারি লাইন পার হতেই জানিথ লিয়ানাগে রাগে হেলমেট ও গ্লাভস ছুঁড়ে ফেললেন মাঠে। কারণ ততক্ষণে তিনি জেনে গেছেন, আগের ওভারে হাঁকানো ছক্কাটির আর কোনো মূল্য নেই। তার সংগ্রামী ৭৮ রানের ইনিংসটিও মূল্যহীন হয়ে গেছে মোস্তাফিজুর রহমানের এক জাদুকরী কাটারে। ম্যাচের পুরো সময় উইকেটহীন থাকা মোস্তাফিজ শেষ মুহূর্তে তুলে নিলেন ম্যাচের মোড় ঘুরিয়ে দেওয়া গুরুত্বপূর্ণ উইকেটটি। শেষ হয়ে গেল সব অনিশ্চয়তা।
এরপর তানজিম সাকিব ও তার আগেই তানভির ইসলামের দুর্দান্ত বোলিং—সব মিলিয়ে বাংলাদেশ পেল এক অমূল্য জয়। কতটা অমূল্য? সাত মাস ও টানা সাতটি হারের পর এই জয়, যার মূল্য সহজেই অনুমেয়। ১৬ রানের এই শ্বাসরুদ্ধকর জয় কেবল সিরিজে সমতা আনেনি, বরং বাংলাদেশ দলকে নতুন করে আত্মবিশ্বাসে ভরিয়ে দিয়েছে। তিন ম্যাচের ওয়ানডে সিরিজে এখন ১-১ সমতা। ফলে ফয়সালাটা গড়াচ্ছে পাল্লেকেলেতে।
প্রেমাদাসার উইকেটে ২৪০ রান তাড়া করা কতটা কঠিন, তা বাংলাদেশের চেয়ে ভালো আর কে জানে! বাংলাদেশের পুঁজি ছিল ২৪৮ রান, আধুনিক ক্রিকেটে যেটা খুব বড় নয়, কিন্তু দ্বিতীয় ওয়ানডের প্রেক্ষাপটে এই রানটা কম মনে হয়নি অধিনায়ক মেহেদী হাসান মিরাজের কাছে। ম্যাচশেষেও তা অকপটে স্বীকার করলেন তিনি।
তবে লঙ্কানরা বারবার চোখরাঙানি দিয়ে গেছে। তিনে নামা কুশল মেন্ডিস মাত্র ৩১ বলে তুলেছেন ৫৬ রান। তাকে যোগ্য সঙ্গ দিয়েছেন নিশান মাদুশকা। শ্রীলঙ্কা ইনিংসের দশম ওভার শেষ হওয়ার আগেই স্কোরবোর্ডে উঠে গেছে ৭৫ রান! তখন দৃশ্যপট ছিল একেবারে লঙ্কানদের অনুকূলে।
তবে ম্যাচে মোড় আনলেন বাঁহাতি স্পিনার তানভির ইসলাম। আগের দুই ওভারে ২২ রান দেওয়া এই বোলার হঠাৎই ঘুরে দাঁড়িয়ে প্রথমে ফেরালেন মাদুশকাকে, পরের ওভারে সাজঘরে পাঠালেন ভয়ঙ্কর মেন্ডিসকে।
এরপর দলকে চাপে ফেললেন অধিনায়ক মিরাজ। তবে তা বোলিংয়ে নয়, চমৎকার অধিনায়কত্বে। বুঝতে পেরে যে উইকেটে স্পিন সাহায্য করছে, আক্রমণে আনলেন নিজেকে ও শামীম হোসেন পাটোয়ারীকে। শামীমের বোলিং দক্ষতা এতদিন অনাবিষ্কৃত থাকলেও এবার তা কাজে লাগল ভালোভাবেই। দুজন মিলে ১৪ থেকে ২৫ ওভারের মাঝে দিলেন মাত্র ৩৭ রান। চাপ বাড়তেই আসালঙ্কাকে ফেরালেন শামীম।
শেষ দিকে যদিও এই দুই স্পিনার কিছুটা রান খরচ করতে থাকেন, কিন্তু ততক্ষণে ম্যাচের নিয়ন্ত্রণ অনেকটাই বাংলাদেশের হাতে। আবারও আক্রমণে আনা হলো তানভিরকে, যিনি ফিরিয়ে দিলেন আরেক বিপদজনক ব্যাটার কামিন্দু মেন্ডিসকে। এরপর পেলেন ভেল্লালাগের উইকেটটিও।
শ্রীলঙ্কা তখনও ৭৮ রানের দূরত্বে। প্রতিরোধ গড়তে চেষ্টা করলেন লিয়ানাগে। শুরুতে দেখলেন হাসরাঙ্গা ও থিকসানার বিদায়, এরপর এগোতে থাকলেন চামিরাকে সঙ্গে নিয়ে।
লিয়ানাগের এই ইনিংস বেঁচে থাকার পেছনে অবশ্য বড় অবদান জাকের আলীর। মোস্তাফিজের বলে একটি সহজ ক্যাচ ফেলেছিলেন জাকের, যেখানে লিয়ানাগে থেমে যেতে পারতেন ৭৮ রানে। ওই ক্যাচ ধরতে পারলে হয়তো ম্যাচ শেষ হয়ে যেত ঘণ্টাখানেক আগেই।
কিন্তু তা হয়নি। ফলে ম্যাচ গড়াল ৪৮তম ওভারে। মোস্তাফিজের প্রথম বলে লিয়ানাগে হাঁকালেন বিশাল এক ছক্কা, আগের ওভারে মাত্র এক রান দেওয়া মোস্তাফিজকে তখনই চাপে ফেলে দিলেন তিনি।
কিন্তু পরের বলেই মোস্তাফিজ ফেরালেন সেই আস্থা। মিড উইকেট আর লং অনকে ওপরে রেখে শর্ট লেন্থে বলটি করেছিলেন কাটার দিয়ে। লিয়ানাগে খেলতে গিয়ে বল তুলে দিলেন আকাশে। বল গিয়ে পড়ল মোস্তাফিজেরই হাতে। বাংলাদেশের জয় তখন কেবল সময়ের ব্যাপার।
শ্রীলঙ্কান ইনিংসের শুরুতেও আঘাত দিয়েছিলেন তানজিম সাকিব। শেষটাও তার হাতেই হলো। চামিরাকে বোল্ড করে নিশ্চিত করলেন ১৬ রানের রুদ্ধশ্বাস জয়।
এর আগে টস জিতে ব্যাটিংয়ে নেমে শুরুতেই ভালো সূচনা পায় বাংলাদেশ। তানজিদ তামিম ও শান্ত ফিরে গেলেও রান তুলতে থাকেন পারভেজ হোসেন ইমন। ৬৯ বলে ৬৭ রানের ইনিংসে ছয়টি চার ও তিনটি ছক্কা হাঁকান তিনি।
তার বিদায়ের পর ইনিংস ধরে রাখেন তাওহীদ হৃদয়। একপাশ আগলে রেখে ৫১ রান করেন তিনি। ইনিংসজুড়ে মাত্র দুটি চার মারলেও দৌড়ে রান তুলে নিয়েছেন নিয়মিত। তবে অতিরিক্ত এক রান নিতে গিয়ে ভুল বোঝাবুঝিতে রানআউট হয়ে ফেরেন হৃদয়। তখনো বাংলাদেশের স্কোর ছিল ২২০ এর নিচে। এরপর হাসান মাহমুদ ও তানভির ইসলামের বিদায়ে মনে হচ্ছিল ২২৫-ও হয়তো কঠিন।
শেষ উইকেটে তানজিম সাকিব ও মোস্তাফিজ গড়লেন ৩০ রানের জুটি। মোস্তাফিজ ৭ বল খেলে রানে ফেরেননি, কিন্তু তার ধৈর্যই সুযোগ করে দিল তানজিমকে ঝড় তোলার। মাত্র ২১ বলে ৩৩ রান করে দলের স্কোর এনে দিলেন প্রায় আড়াইশোর কাছাকাছি।
শেষমেশ এই সংগ্রহই যথেষ্ট প্রমাণিত হলো। তানভির, শামীম ও মোস্তাফিজের চমৎকার বোলিংয়ে লঙ্কানদের থামিয়ে দিয়ে সিরিজে সমতায় ফিরল বাংলাদেশ। এখন ফয়সালার জন্য অপেক্ষা, পাল্লেকেলেতে অনুষ্ঠিতব্য শেষ ম্যাচেই নির্ধারিত হবে সিরিজ বিজয়ী দল।