গাজায় মানবিক সহায়তা নিতে আসা মানুষের ওপর ইসরায়েলি বাহিনীর হামলায় অন্তত ৭০ জন ফিলিস্তিনি নিহত হয়েছেন এবং শত শত মানুষ আহত হয়েছেন। মঙ্গলবার (১৭ জুন) সকালে দক্ষিণ গাজা উপত্যকার খান ইউনিস শহরের পূর্বাঞ্চলীয় প্রধান সড়কে এই হামলা চালানো হয়।
স্থানীয় সময় মঙ্গলবার সকালে এই হামলার সময় ইসরায়েলি সেনারা ট্যাংকের গোলা, ভারী মেশিনগান ও ড্রোন ব্যবহার করে জনতার ওপর গুলি চালায়। আহতদের অনেকের অবস্থা আশঙ্কাজনক বলে জানিয়েছেন নাসের হাসপাতালে কর্মরত চিকিৎসকেরা। তারা জানিয়েছেন, মৃতের সংখ্যা আরও বাড়তে পারে।
গাজা সিভিল ডিফেন্সের মুখপাত্র মাহমুদ বাসাল বলেন, “ইসরায়েলি ড্রোন থেকে নাগরিকদের লক্ষ্য করে গুলি চালানো হয়। কিছুক্ষণ পর ট্যাংক থেকে কয়েক দফা শেল নিক্ষেপ করা হয়, যাতে বহু মানুষ শহীদ ও আহত হন।”
তিনি আরও জানান, ওই সময় শত শত মানুষ শুধু এক বস্তা আটার আশায় সড়কে জড়ো হয়েছিলেন।
আল জাজিরার প্রতিবেদক হানি মাহমুদ জানান, প্রত্যক্ষদর্শীদের বরাতে বলা হয়েছে—ইসরায়েলি ট্যাংক, ভারী মেশিনগান এবং ড্রোন হামলা একযোগে জনতার ওপর চালানো হয়। এতে রাস্তায় ছড়িয়ে-ছিটিয়ে পড়ে থাকে রক্তাক্ত মৃতদেহ।
এই ঘটনার মধ্য দিয়ে গাজায় চলমান GHF (Gaza Humanitarian Foundation)-এর ত্রাণ বিতরণ কেন্দ্রগুলোর কাছে একদিনে সবচেয়ে বেশি হতাহতের রেকর্ড গড়া হলো। আগের দিন, সোমবার, রাফাহ এলাকায় ৩৮ জন নিহত হয়েছিলেন।
আন্তর্জাতিক সংস্থাগুলোর তথ্য মতে, গত ২৬ মে থেকে GHF গাজায় খাদ্য সহায়তা কার্যক্রম শুরু করে। এরপর থেকে প্রতিদিনই হামলার ঘটনা ঘটছে। এখন পর্যন্ত অন্তত ৩০০ জনের বেশি নিহত এবং দুই হাজারেরও বেশি মানুষ আহত হয়েছেন কেবল ত্রাণ নিতে গিয়েই।
জাতিসংঘ মহাসচিব আন্তোনিও গুতেরেস এই হত্যাকাণ্ডের ঘটনায় দায়ীদের জবাবদিহির আহ্বান জানিয়েছেন। তার উপপ্রবক্তা ফারহান হাক নিউইয়র্কে এক বিবৃতিতে বলেন, “মানুষ যখন খাবারের খোঁজে যায়, তখন তাদের গুলি করে হত্যা করার ঘটনা কোনোভাবেই গ্রহণযোগ্য নয়।”
তিনি জানান, সোমবার পর্যন্ত হিসাব অনুযায়ী, ত্রাণকেন্দ্রের কাছে গুলি ও হামলায় ৩৩৮ জন নিহত এবং ২,৮০০ জনের বেশি আহত হয়েছেন।
এই বীভৎস ঘটনার প্রত্যক্ষদর্শী ও বেঁচে যাওয়া কয়েকজন গাজাবাসী আল জাজিরাকে জানান ভয়াবহ অভিজ্ঞতার কথা।
৩৮ বছর বয়সী সাঈদ আবু লিবা বলেন, “ডজনখানেক নারী ও শিশুকে মরে পড়ে থাকতে দেখেছি, কেউ সাহায্যও করতে পারছিল না।”
আরেকজন, ইউসুফ নোফাল বলেন, “মানুষকে পেছন দিক থেকে গুলি করা হচ্ছিল। এটা ছিল এক গণহত্যা।”
মোহাম্মদ আবু কাশফা বলেন, “আমি অলৌকিকভাবে বেঁচে গেছি। চারপাশে গুলির শব্দ আর ট্যাংকের গোলায় মানুষের শরীর ছিন্নভিন্ন হচ্ছিল।”
আল জাজিরার অপর সাংবাদিক তারেক আবু আজজৌম, যিনি দেইর আল-বালাহ শহর থেকে প্রতিবেদন পাঠাচ্ছিলেন, জানান—নাসের হাসপাতালের চিকিৎসকেরা বলছেন অনেক মরদেহ এতটাই ছিন্নভিন্ন যে চেনার উপায় নেই।
GHF কার্যক্রম চালু হলেও জাতিসংঘ ও অনেক আন্তর্জাতিক মানবিক সংগঠন এতে অংশ নিচ্ছে না। তাদের অভিযোগ—এই ত্রাণকেন্দ্রগুলো মূলত ইসরায়েলি সামরিক কৌশল বাস্তবায়নের অংশ হিসেবে ব্যবহৃত হচ্ছে, মানবিক প্রয়োজনকে অগ্রাধিকার দেওয়া হচ্ছে না।
ইসরায়েল একদিকে খাদ্য ও ওষুধের প্রবেশে দীর্ঘদিন ধরে নিষেধাজ্ঞা দিয়ে রেখেছে, অপরদিকে নিজস্ব শর্তে নিয়ন্ত্রিত GHF ত্রাণ বিতরণ কেন্দ্রগুলো চালাচ্ছে। মানবাধিকার সংগঠনগুলো বলছে, এটি গাজাবাসীর প্রতি আরও নিষ্ঠুরতা।
বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা (WHO) মঙ্গলবার জানায়, গাজার হাসপাতালগুলোর জন্য জরুরি জ্বালানি সরবরাহ প্রয়োজন। সংস্থাটির প্রতিনিধি রিক পিপারকর্ন বলেন, “১০০ দিনের বেশি সময় ধরে গাজায় কোনো জ্বালানি প্রবেশ করতে দেওয়া হয়নি। যেসব অঞ্চলে জ্বালানির মজুদ ছিল, সেখান থেকেও নিতে দেওয়া হচ্ছে না।”
তিনি আরও জানান, গাজার ৩৬টি হাসপাতালের মধ্যে মাত্র ১৭টি কোনোভাবে আংশিকভাবে চালু আছে। সেগুলোতে মাত্র ১,৫০০টি বেড রয়েছে, যা আগের চেয়ে প্রায় ৪৫ শতাংশ কম।
এক বস্তা আটার আশায় জড়ো হওয়া নিরস্ত্র মানুষের ওপর গুলিবর্ষণ এবং গোলাবর্ষণ যেন এখন নিত্যদিনের ঘটনায় পরিণত হয়েছে গাজায়। বিশ্ব বিবেকের চরম পরীক্ষার মধ্যে দিয়ে যাচ্ছে ২৩ লাখ মানুষ। জাতিসংঘের কড়া নিন্দা সত্ত্বেও এই রক্তপাত থামছে না। আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের জবাব এখন গাজাবাসীর বেঁচে থাকার প্রশ্নে পরিণত হয়েছে।