Site icon আজকের কাগজ

উদ্যোক্তা  তৈরির নতুন উচ্ছ্বাস ইডেন মহিলা কলেজ প্রাঙ্গণে 

উদ্যোক্তা তৈরির নতুন উচ্ছ্বাস ইডেন মহিলা কলেজ প্রাঙ্গণে

জান্নাতুল মাওয়া শিক্ষার্থী, ইডেন মহিলা কলেজ : একটা সময় ছিল যখন নারীদের স্বপ্ন দেখার নিষেধাজ্ঞা ছিল, ছিল চার দেয়ালের গণ্ডি পেরিয়ে মুক্ত জগতকে জানার প্রতিবন্ধকতা, রুদ্ধতা ছিল ভয়কে জয় করার, স্বপ্ন পূরণে আকাশে যাওয়ার। কিন্তু সময়ের পালাক্রমের সাথে সাথে সেই নিষেধাজ্ঞা এখন শুধু  সমাজের একটি কুসংস্কারমাত্র, যা আজকের নারীরা তাদের অদম্য ইচ্ছাশক্তি, শিক্ষার আলো এবং আত্মবিশ্বাস দিয়ে ভেঙে ফেলছে। আর তাদের এই ইচ্ছাশক্তিকে লক্ষ্যে পৌঁছাতে, স্বপ্নকে বাস্তব রূপ দেয়ার অদম্য প্রচেষ্টা এবং ভবিষ্যৎ সম্ভবনাকে সুদৃঢ় করতে  বাংলাদেশের স্বনামধন্য শিক্ষা প্রতিষ্ঠান ইডেন মহিলা কলেজের সার্বিক সহায়তায় SME (Small Medium Enterprises) Foundation নারী উদ্যোক্তা সৃষ্টি ও উদ্বুদ্ধ করন বিষয়ক কর্মশালা -“এস উদ্যোক্তা হই “এর আয়োজন করেন।

অনুষ্ঠানটিতে অংশগ্রহণের জন্য ইডেন ক্যাম্পাসের মিলনায়তনে ঝাঁকে ঝাঁকে শিক্ষার্থীদের পদচারণার শুরু হয়। চোখে মুখে উদ্দীপনা, স্বপ্নের জাল বুনে আকাশসম বিশালতা অর্জনের এক সুপ্ত বাসনা তাদেরকে উদ্যোক্তা হওয়ার এই কর্মশালাটি অংশগ্রহণের অনুপ্রেরণা জোগায়। “এসো উদ্যোক্তা হই” এর এ যাত্রাটি মূলত একজন শিক্ষার্থী শিক্ষাজীবনের পরবর্তী সময়ে চাকরির পিছনে   না ছুটে নিজেকে উদ্যোক্তা হিসেবে আবিষ্কার করার লক্ষ্য নিয়ে উপস্থিত হয়েছে। 

নারী উদ্যোক্তা তৈরির লক্ষ্যে নারীদের আত্মনির্ভরশীল, আত্মকর্মসংস্থানে সক্ষম ও আত্মপ্রত্যয়ী হিসেবে গড়ে তোলার উদ্দেশ্যে কর্মশালার উদ্বোধনী পর্ব শুরু হয়। অনুষ্ঠানটিতে স্বাগত বক্তব্য ও কর্মসূচির ধারণা দেন এসএমই ফাউন্ডেশন  উপব্যবস্থাপনা পরিচালক -জনাব ফারজানা খান। তিনি বলেন -“নারীদের ক্ষমতায়নের জন্য উদ্যোক্তা হওয়া অত্যন্ত জরুরী। সমাজে নারীদের অবস্থান সুদৃঢ় করতে তাদের আত্মনির্ভরশীল হতে হবে। “

এসএমই ফাউন্ডেশন কর্তৃক আয়োজিত কর্মশালাটির সভাপতিত্ব করেন ইডেন মহিলা কলেজের অধ্যক্ষ অধ্যাপক ড.শামছুন নাহার। তিনি তার বক্তব্য বলেন -“চাকরির পেছনে না ছুটে নিজেকে উদ্যোক্তা হিসেবে গড়ে তোল। কেননা আত্মকর্মসংস্থান তোমাকে স্বাবলম্বী করবে।”

অনুষ্ঠানটিতে প্রধান অতিথি হিসেবে উপস্থিত ছিলেন এস এম ই ফাউন্ডেশন এর সম্মানিত চেয়ারম্যান জনাব মোঃ মুশফিকুর রহমান। তিনি তার বক্তব্যে উপস্থাপন করেন বেকারত্বের ফলে বাংলাদেশের অর্থনৈতিক অবস্থার। তিনি বলেন -বর্তমান সময়ে উচ্চশিক্ষিত বেকারত্বের হার ২১ শতাংশ এবং এই জাতীয় সমস্যা থেকে বেরিয়ে আসতে হলে দেশে উদ্যোক্তা তৈরীর কোন বিকল্প নেই। আর দেশে অর্থনৈতিক সফলতা আনতে নারীদের পিছিয়ে থাকলে চলবে না। ভবিষ্যৎ বাংলাদেশের অর্থনৈতিক অবকাঠামো নির্মাণের জন্য তাদেরকে এগিয়ে আসতেই হবে। “

অনুষ্ঠানটির এ পর্যায়ে বিশেষ অতিথির জনাব আনোয়ার হোসেন চৌধুরী, এর ব্যবস্থাপনা পরিচালক নারীদের উদ্যোক্তা হওয়ার ক্ষেত্রে ফাউন্ডেশনের বিভিন্ন কার্যক্রম সম্পর্কে বিস্তারিত আলোচনা করেন। তিনি নতুন উদ্যোক্তা সৃষ্টি এবং  অপ্রতিষ্ঠানিক উদ্যোক্তাদের প্রতিষ্ঠানিকীকরণসহ প্রশিক্ষণ প্রদান, ব্যবসায় পরামর্শ, সহযোগিতা, কারিগরি সহায়তা, নীতি নির্ধারণী এডভোকেসি, ঋণ সহায়তা, নেটওয়ার্ক ও বাজার সংযোগ সম্পর্কে যাবতীয় সকল তথ্য উপস্থাপন করেন। “

“এসো উদ্যোক্তা হই “কর্মশালাটির সবচেয়ে চমকপ্রদ একটি অংশ বাংলাদেশের স্বনামধন্য তিন নারী উদ্যোক্তা-জনাব কানিজ আলমাস খান, (সিইও, পার্সোনাল লিমিটেড), জনাব লিপি খন্দকার (স্বত্বাধিকারী, বিরিয়ানা) এবং জনাব ফারহানা (এ.রহমান, ম্যানেজিং পার্টনার, ইউ ওয়াই সিস্টেম লিমিটেড) এর উপস্থিতি এবং তাদের বক্তব্য। তাদের উদ্যোক্তা হওয়ার পিছনের  প্রথম ধাপ, বাধা, অর্জন, জীবনের  উথান-পতন এবং সংগ্রামের মাধ্যমে সফলতা অর্জনের প্রত্যক্ষ উদাহরণ যেন অনুষ্ঠানটির সার্থকতা বয়ে আনে। তাদের আত্মজীবনের সারাংশ যেনো ইডেন মহিলা কলেজের উপস্থিত সকল শিক্ষার্থীদের উদ্যোক্তা হওয়ার জন্য সচেষ্ট করে তুলে। 

জনাব কানিজ আলমাস ইডেন মহিলা কলেজের ইতিহাস বিভাগের একজন ছাত্রী ছিলেন। তিনি বলেন -“ইডেন কলেজ থেকে আমার যাত্রা শুরু। পথসহ ছিল না, কিন্তু স্বপ্নে স্থির ছিলাম। আমি চাই তোমরা পড়াশোনা শেষ করে শুধু চাকরির জন্য বসে থেকো না, নিজের জন্য, অন্যের জন্য কাজ কর। “

লিপি খন্দকার তার সংগ্রামী জীবনের ঘটনা বলতে গিয়ে  বলেন -“আমি ছোটবেলা আর্টিস্ট দের ব্যাগ কাঁধে নিয়ে হাঁটতাম আর বলে বেড়াতাম আমি বড় হয়ে আর্টিস্ট হব। সমাজের, পরিবারের সকল বাধা পেরিয়ে নিজের লক্ষ্যের প্রতি দৃঢ় সংকল্পবদ্ধ ছিলাম। আর তারই পরিক্রমায় আজ আমি একজন সফল ফ্যাশন ডিজাইনার। এই ফ্যাশন ডিজাইনার হওয়ার পিছনে সবচেয়ে বড় অনুপ্রেরণা ছিল আমার মায়ের। তার কাছ থেকেই শিখেছি নকশি কাঁথা সেলাইয়ের নানান ডিজাইন। “

নারীকে সফল উদ্যোক্তা তৈরীর ক্ষেত্রে এক বিশেষ সুযোগ থাকে আইটি সেক্টরে। বর্তমানে বাংলাদেশের অন্যতম আইটি সেক্টরের একজন সফল উদ্যোক্তা জনাব ফারহানা এ.রহমান। তিনি নারী শিক্ষার্থীদের প্রযুক্তি ভিত্তিক উদ্যোক্তা হওয়ার জন্য অনুপ্রেরণা দেন। তিনি বলেন -“সারা বিশ্বে মাত্র ৩ শতাংশ নারী উদ্যোক্তা রয়েছেন। তবে টেকনোলজি এমন একটি সেক্টর যা চতুর্থ শিল্প বিপ্লবের একটু অন্যতম মাধ্যম। এ মাধ্যমটি উদ্যোক্তা তৈরিতে অসম্ভব অবদান রাখে। নারীদের উদ্যোক্তা তৈরির ক্ষেত্রে টেকনোলজি খুব কঠিন মাধ্যম নয়। যদি কঠিন হতো তাহলে আমি আজ টেক সেক্টরে আসতে পারতাম না।”

উদ্যোক্ত হওয়ার স্বপ্ন বাস্তবায়নের লক্ষ্যে উচ্ছ্বাসিত শিক্ষার্থীরা বক্তাদের বিভিন্ন ধরনের প্রশ্ন করে থাকেন। তারা জানতে চান -কিভাবে পোর্টফোলিও বানাবেন,  কোন সেক্টর বেশি সম্ভাবনাময়,  প্রযুক্তির ভবিষ্যৎ ও স্থানীয় বনাম আন্তর্জাতিক কাজ নিয়ে তাদের যাবতীয় সকল প্রশ্ন করে থাকেন।

আর এই প্রশ্নগুলোর যথাযথ উত্তর দিয়ে শিক্ষার্থীদের মাঝে এক বিপ্লবী আন্দোলনের সৃষ্টি করে। যা শুধু তাদের বীজ বপন অব্দি দীর্ঘস্থায়ী নয়, বরং তা তাদের বৃক্ষে পরিণত করবে।কর্মশালাটির এক পর্যায়ে বক্তাদের বক্তব্যে অনুপ্রাণিত হয়ে শিক্ষকগণ তাদের আগ্রহ প্রকাশ করেন। তারা বলেন তারা তাদের শিক্ষকতার পেশার পাশাপাশি উদ্যোক্তা হওয়ার স্বপ্ন দেখেন। স্বপ্নের পথে বিচরণ দেখে ইংরেজি দার্শনিক ও আত্মউন্নয়নমূলক লেখক জেমস অ্যালেনের ভাষায় বলতে হয়- “Dreams are all seeding of realities. ” যেখানে স্বপ্নকে বাস্তবতার বীজ বলে আখ্যায়িত করা হয়েছে।

এসএমই ফাউন্ডেশন এর পক্ষ থেকে অংশগ্রহণকারীদের জন্য সৌজন্যমূলক উপহার হিসেবে নোটবুক ও কলমের আয়োজন করা হয়। তবে সৌজন্যেমূলক উপহারের এই আয়োজন থেকেও শিক্ষার্থীদের জন্য বড় আয়োজন ছিল তাদের অন্তরে উদ্যোক্তার বীজ বপন করা । যা তাদের জীবনে এক নতুন মোড়ের সূচনা করবে এবং নতুন এক সম্ভবনাময় ভবিষ্যৎ এর পথে এগিয়ে নিয়ে যাবে। আর তাদের সফলতার চরম শিখায় পৌঁছে দিবে।

ইডেন মহিলা কলেজের ইংরেজি বিভাগের চেয়ারম্যান অধ্যাপক ফাহিমা মাহমুদের সমাপনী বক্তব্যের মাধ্যমে কর্মশালাটির ইতি টানা হয়। তবে এ ইতি কেবল “এসো উদ্যোক্তা হই ” অনুষ্ঠানটির পরিসমাপ্তি হলেও এর ভবিষ্যৎ সুদূরপ্রসারী। কেননা এটি শুধুমাত্র একটি কর্মশালা নয়, এটি শিক্ষার্থীদের ভবিষ্যৎ জীবন বদলে দেওয়ার একটি বিশাল আয়োজন। যা 

তাদেরকে সমৃদ্ধ করার পাশাপাশি আগামীর বাংলাদেশকে নতুন এক অর্থনৈতিক অবকাঠামো উপহার দিবে।

Exit mobile version