বাংলাদেশে বিদেশি বিনিয়োগ সম্মেলনের মাঝেই, গত ৮ এপ্রিল হঠাৎ ট্রান্সশিপমেন্ট চুক্তি বাতিলের ঘোষণা দেয় ভারত। এর ফলে ভারতীয় বন্দর ব্যবহার করে তৃতীয় দেশে পণ্য রপ্তানির সুযোগ হারায় বাংলাদেশ। এরপর, ১৬ এপ্রিল থেকে বাংলাদেশও স্থলবন্দর দিয়ে ভারতের সুতা আমদানি বন্ধ করে দেয়। এতদিন বেনাপোল, ভোমরা, সোনামসজিদ, বাংলাবান্ধা ও বুড়িমারী হয়ে এই সুতা আমদানি হতো।
এই পরিস্থিতিতে প্রশ্ন উঠেছে—এই টানাপোড়েনে কে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে, আর কে লাভবান? খাতসংশ্লিষ্টরা ভারতের একতরফা সিদ্ধান্তকে অস্বাভাবিক বলেই মনে করছেন।
বাংলাদেশের সমস্যা হবে না?
বাণিজ্য উপদেষ্টা শেখ বশিরউদ্দীন জানিয়েছেন, ট্রান্সশিপমেন্ট সুবিধা বাতিলের ফলে বাংলাদেশের বড় কোনো ক্ষতি হবে না। যদিও এতে পরিবহন ব্যয় প্রায় ২ হাজার কোটি টাকা বেড়েছে, তবুও সরকারের বিভিন্ন পদক্ষেপে এ ব্যয় কমিয়ে আনা সম্ভব হবে বলে তিনি আশাবাদী। ব্যবসায়ীদের সঙ্গে আলোচনা করেই বিকল্প ব্যবস্থা নেওয়া হচ্ছে।
ভারতের যুক্তি
এই সিদ্ধান্তের পেছনে যানজটই মূল কারণ—এমনটাই জানিয়েছেন ভারতের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের মুখপাত্র রণধীর জয়সওয়াল। তার মতে, বন্দরগুলোর চাপ কমাতেই এই পদক্ষেপ।
ট্রান্সশিপমেন্ট হলো এমন এক প্রক্রিয়া, যেখানে একটি দেশ তৃতীয় দেশে পণ্য পাঠাতে অন্য দেশের বন্দর ব্যবহার করে। ২০২০ সালের ২৯ জুন বাংলাদেশ-ভারতের মধ্যে ট্রান্সশিপমেন্ট চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়। কিন্তু চলতি বছরের ৮ এপ্রিল ভারতের সেন্ট্রাল বোর্ড অব ইনডাইরেক্ট ট্যাক্সেস অ্যান্ড কাস্টমস (CBIC) একতরফাভাবে চুক্তিটি বাতিল করে।
আসলে কতটা ক্ষতি?
বিশ্লেষকরা বলছেন, বাংলাদেশ এই সুবিধা অতটা ব্যবহার করতো না, মূলত নেপাল ও ভুটানে পণ্য পাঠাতেই এটি কাজে লাগানো হতো। ভারতে তৈরি পোশাক পাঠানো হতো ইউরোপ ও আমেরিকায়, যা এখন বন্ধ হয়ে গেছে।
কার্গো সংকট: খরচ বাড়ছেই
ঢাকা থেকে ইউরোপগামী এয়ার কার্গোর স্পট রেট বেড়ে প্রতি কেজিতে ৬.৫০ ডলার হয়েছে। যুক্তরাষ্ট্রে এই হার ৭.৫০ থেকে ৮ ডলার পর্যন্ত পৌঁছেছে, যেখানে ২০২৪ সালের আগস্টে ছিল ৬.৯১ ডলার। অথচ কলকাতা থেকে একই গন্তব্যে প্রতি কেজিতে খরচ মাত্র ৪ ডলার, মালদ্বীপ থেকে ৩.৫০ ডলার।
রপ্তানিকারকদের অভিযোগ, এখন বাড়তি খরচ দিতে হচ্ছে গ্রাউন্ড হ্যান্ডলিং, স্ক্যানিং ও ওয়্যারহাউজ স্টোরেজ বাবদ। টিএডি গ্রুপের এমডি আশিকুর রহমান তুহিন বলছেন, এতে ব্যবসায়িক ব্যয় বেড়ে যাবে, লিড টাইম বাড়বে এবং প্রতিযোগিতা সক্ষমতা কমে আসবে।
বিজিএপিএমইএ সভাপতি মো. শাহরিয়ার বলেন, ইউরোপে পণ্য পাঠাতে এখন কেজিতে ৬ ডলার খরচ হচ্ছে, কিন্তু ফরোয়ার্ডাররা জানাচ্ছেন খরচ আরও বাড়বে। সরকারের উচিত দ্রুত কার্গো সেবা বাড়ানো এবং বিমানবন্দরের জট নিরসন করা, না হলে প্রধান বাজার থেকে বাংলাদেশ ছিটকে পড়তে পারে।
সুতা আমদানিতে এক নতুন হিসাব
স্থলবন্দর দিয়ে সুতা আমদানির বিরুদ্ধে দীর্ঘদিন ধরেই অভিযোগ ছিল। মিথ্যা ঘোষণা দিয়ে কম দামে উন্নতমানের সুতা আনার অভিযোগ ছিল ব্যবসায়ীদের। ৩০ কাউন্টের নামে ৮০ কাউন্টের সুতা আসছে—এমন অভিযোগও ছিল। কাস্টমসে লোকবলের ঘাটতির কারণে পর্যাপ্তভাবে যাচাই করা সম্ভব হয় না। বেনাপোলে একসময় সূক্ষ্মতা পরিমাপের যন্ত্র থাকলেও তা অকেজো হয়ে গেছে।
তবে সড়কপথের তুলনায় সমুদ্রপথে সুতা আনতে খরচ ১০ শতাংশ কম পড়ে এবং সময়েও খুব বেশি পার্থক্য নেই। কর্ণাটক, তামিলনাড়ু ও গুজরাট থেকে সড়কপথে সুতা আসতে ১০-১২ দিন লাগে, আর চেন্নাই থেকে চট্টগ্রাম বন্দরে পৌঁছাতে সময় লাগে প্রায় দুই সপ্তাহ।
ভারতের মাধ্যমে কত কার্গো যেত?
ফ্রেইট ফরওয়ার্ডার ও গার্মেন্টস রপ্তানিকারকদের তথ্যমতে, বাংলাদেশের প্রায় ১৮ শতাংশ সাপ্তাহিক এয়ার কার্গো—যা প্রায় ৬০০ টন—ভারতের মাধ্যমে পরিবাহিত হতো। ২০২৪ সালের জানুয়ারি থেকে ২০২৫ সালের মার্চ পর্যন্ত প্রায় ৩৫ হাজার টনের বেশি পণ্য ভারত হয়ে ইউরোপ, আমেরিকা ও এশিয়ার বিভিন্ন দেশে গেছে, যার মূল্য প্রায় ৪৬২ মিলিয়ন ডলার।
ঢাকা বিমানবন্দরের সীমাবদ্ধতা
হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে কার্গো হ্যান্ডলিংয়ের সক্ষমতা সীমিত। ২০২৪ সালে এখানে প্রক্রিয়াজাত হয় প্রায় ২ লাখ টন রপ্তানি ও ৫০ হাজার টন আমদানি পণ্য। এমিরেটস, কাতার, টার্কিশ, সৌদিয়া, ইতিহাদ ও বিমান বাংলাদেশ—এই ছয়টি এয়ারলাইন্স প্রধান পরিবহনকারী। অন্যদিকে, সিলেট ও চট্টগ্রামের বিমানবন্দর কার্গো হ্যান্ডলিংয়ে অপ্রতুল।
সমাধান কীভাবে সম্ভব?
বিমান বাংলাদেশের সাবেক পরিচালক কাজী ওয়াহিদুল আলম মনে করেন, দ্রুত সমাধানের জন্য ঢাকার থার্ড টার্মিনাল চালু করা জরুরি। পাশাপাশি, চট্টগ্রাম বিমানবন্দরে অস্থায়ীভাবে তৃতীয় পক্ষের অপারেটর নিয়োগ দিতে হবে। থার্ড টার্মিনাল চালু হলে শাহজালালের কার্গো হ্যান্ডলিং ক্ষমতা তিনগুণ বেড়ে বছরে ৫.৪৭ লাখ টনে পৌঁছাতে পারে। বর্তমানে তিনটি স্ক্যানিং মেশিনের মধ্যে একটি প্রায়ই বিকল থাকে, এটি দ্রুত ঠিক করা দরকার।
উল্লেখযোগ্য প্রেক্ষাপট
স্থলবন্দর দিয়ে সুতা আমদানি বন্ধের দাবি নতুন নয়। চলতি বছরের ফেব্রুয়ারিতে বাংলাদেশ টেক্সটাইল মিলস অ্যাসোসিয়েশন (BTMA) স্থলপথে সুতা আমদানি বন্ধের দাবি জানায়। এবার সেই দাবিই বাস্তবায়নের পথে।