
সৈয়দ মুজিবুর রহমান দুলাল, লাকসাম : কুমিল্লার লাকসাম ইক্বরা মহিলা মাদ্রাসার ছাত্রী সামিয়া হত্যাকাণ্ডের ২২দিনেও মামলার কোনো অগ্রগতি নেই ! এখন পর্যন্ত পুলিশ কোনো আসামী গ্রেপ্তার পারেনি! মামলায় পুলিশের গা ছাড়া ভাব, কোনো আসামি গ্রেপ্তার না হওয়ায় হতাশ সামিয়ার পরিবার, ক্ষুব্ধ এলাকাবাসী। তাহলে কি সামিয়া হত্যা মামলা অন্ধকারেই থেকে যাবে? আদৌ কি আলোর মুখ দেখবে? এমন প্রশ্ন স্বজন ও এলাকাবাসীর।
গত ১৭ এপ্রিল (বৃহস্পতিবার) গভীর রাতে (৩:০৯মিনট) ইক্বরা মহিলা মাদ্রাসার নিচে লাকসাম পৌরসভা সড়কের ওপর পড়ে থাকতে দেখে স্থানীয় লোকজন ওই মাদ্রাসার শিক্ষার্থী সামিয়া আক্তারকে (১৩) আহত অবস্থায় উদ্ধার করেন। প্রথমে স্থানীয় একটি হাসপাতালে চিকিৎসা করান। পরে অবস্থার অবনতি হলে চিকিৎসকের পরামর্শে শুক্রবার (১৮ এপ্রিল) সকালে ঢাকায় নিয়ে যান এবং একটি বেসরকারি হাসপাতালে ভর্তি করেন। সেখানে চিকিৎসাধীন অবস্থায় ওইদিন দুপুর সাড়ে ১২টার দিকে মারা যায় সামিয়া।
এদিকে সামিয়ার মৃত্যু নিয়ে তৈরি হয় ধুম্রজাল। ওই মাদ্রাসা কর্তৃপক্ষ বলছেন, সে এই মাদ্রাসায় পড়াশোনা করতে অনাগ্রহী। তাই মাদ্রাসা ভবনের পাঁচতলার একটি জানালার গ্রীলের ফাঁক দিয়ে পালানোর চেষ্টাকালে নিচে পড়ে গুরুতর আহত হয়। অবশেষে চিকিৎসাধীন অবস্থায় মারা যায়।
অপরদিকে সামিয়ার মা শারমিন আক্তারের অভিযোগ, তার মেয়েকে পরিকল্পিত ভাবে হত্যা করে মরদেহ নিচে ফেলে রাখা হয়েছে। এমন অভিযোগ থানা পুলিশকে জানালেও পুলিশ তখন হত্যা মামলা না নিয়ে সামিয়ার মামা নাছির উদ্দিনকে থানায় ডেকে আনেন এবং তাঁর কাছ থেকে একটি লিখিত দরখাস্ত নিয়ে দায়সরা ভাবে অপমৃত্যু মামলা রুজু করেন।
তিনি জানান, মাদ্রাসা সুপার মো. জামাল উদ্দিন বিষয়টি সামাজিক ভাবে সমঝোতার জন্য বিভিন্ন সময় চাপ দেন। পরবর্তীতে গত ২৭ এপ্রিল সামিয়াকে হত্যার অভিযোগে তার মা শারমিন আক্তার লাকসাম থানায় একটি মামলা দায়ের করেন।
তিনি আরো জানান, পাঁচতলার জানালার গ্রীলের ফাঁক (৬ ইঞ্চি) দিয়ে ১৩ বছরের একজন কিশোরী নিচে পড়া একেবারেই অসম্ভব। তবে মাদ্রাসা সুপারের বক্তব্য অনুযায়ী যদি পড়েও থাকে। কোনও ধরনের কাটা-ছেঁড়া, ভাঙ্গাচুরা, রক্তপাত বিহীন অক্ষত শরীরে কিভাবে তাকে উদ্ধার করা হলো? এমন প্রশ্ন কেবল তাঁর একার নয়; অনেকেরই।
এদিকে মামলা দায়েরের পর থেকে মাদ্রাসা সুপার জামাল উদ্দিন, শিক্ষক শারমিন ও দারোয়ান খলিলসহ অনেকেই গা ঢাকা দিয়েছেন বলে সামিয়ার মা শারমিন আক্তারের অভিযোগ।
তাঁর দাবি, মাদ্রাসা সুপার জামাল উদ্দিন, শিক্ষক শারমিন ও দারোয়ান খলিলকে গ্রেপ্তার করে জিজ্ঞাসাবাদ করলে ঘটনার আসল রহস্য উদঘাটন হবে। তিনি এমন দাবি জানিয়ে ওই সময় লাকসাম প্রেসক্লাবে একটি সংবাদ সম্মেলন করেন।
এদিকে সামিয়ার মৃত্যুর রহস্য উদঘাটনের দাবিতে গত ২৩ (এপ্রিল) লাকসাম ও নাঙ্গলকোটে পৃথক বিক্ষোভ সমাবেশ ও মানববন্ধন কর্মসূচি পালন করেছে সামিয়ার পরিবার,পাঠীসহ বিভিন্ন শ্রেণি-পেশার মানুষ। একইদিন সামিয়ার মা ঘটনার সুষ্ঠ তদন্তসহ ন্যায় বিচারের দাবিতে লাকসাম উপজেলা নির্বাহী অফিসার (ইউএনও) বরাবর একটি আবেদন করেন।
সামিয়ার মা’র অভিযোগ, বিক্ষোভ সমাবেশ ও মানববন্ধন কর্মসূচিসহ নানামুখী চাপে অবশেষে লাকসাম থানায় হত্যা মামলা নিতে বাধ্য হয়।
তাঁর অভিযোগ, মেয়ে হত্যার বিচার চেয়ে লাকসাম থানায় মামলা দায়ের করতে গেলে এজাহারে কারো নাম উল্লেখ না করে অজ্ঞাতনামা আসামি উল্লেখ করতে থানার একজন পুলিশ কর্মকর্তা তাঁকে প্রভাবিত করেন। এমনকি এজাহারটি তিনি থানায় বসে সেখানে অপর একজন পুলিশ সদস্যকে দিয়ে থানার কম্পিউটারে লিখিয়েছেন। কম্পিউটারে লিখা ওই এজাহারে আমার দস্তখত নিয়েছেন।
সামিয়ার মা বলেন, মামলা গ্রহণ করার পর এখন পর্যন্ত কোনো অগ্রগতি পরিলক্ষিত হচ্ছে না। ফলে তিনি হতাশা ব্যক্ত করেছেন। এ সময় তিনি কান্নায় ভেঙে পড়েন। তিনি কান্নাজড়িত কণ্ঠে বলেন, প্রভাবশালীর দাপটের কাছে আমরা হেরে যাবো? তবে কি আমার মেয়ে হত্যার বিচার পাবো না?
কুমিল্লার নাঙ্গলকোট পৌরসভার ২ নম্বর ওয়ার্ডের নাওগোদা গ্রামের প্রবাসী নিজাম উদ্দিনের মেয়ে সামিয়া আক্তার। চলতি বছরের ১০ মার্চ লাকসাম ইক্বরা মহিলা মাদ্রাসায় আবাসিকে ভর্তি হয়। ভর্তির মাসখানেক পর তার বড় বোন তাছমিন আক্তার ও খালাম্মা রাবেয়া বেগম গত ১৩ এপ্রিল মাদ্রাসায় আসেন। এ সময় সামিয়াকে ডেকে আনেন। তাঁরা তাকে বাড়ি নেওয়ার অনুরোধ জানিয়ে ছুটি চাইলে মাদ্রাসা সুপার জামাল উদ্দিন ছুটি দেননি। বরং তাঁদের সঙ্গে আশালীন আচরণ করেন। একপর্যায়ে মাদ্রাসার দারোয়ান খলিলুর রহমান তাঁদেরকে গায়ে ধাক্কা দিয়ে বের করে দেন। ওই সময় শারমিন নামে এক শিক্ষক সামিয়াকে টেনে-হিঁছড়ে মাদ্রাসার আবাসিক কক্ষে নিয়ে যান। এ ঘটনার তিন দিন পর সামিয়ার রহস্যজনক মৃত্যু হয়। এমনই অভিযোগ করেন সামিয়ার পরিবার।
লাকসাম থানার অফিসার ইনচার্জ (ওসি) নাজনীন সুলতানা বলেন, ঘটনার সময় আমি ছুটিতে ছিলাম। তবে সংবাদ পেয়ে থানা পুলিশ ঘটনাস্থলে গিয়েছেন। যতটুকু জেনেছি, সামিয়ার মৃত্যুর পর রাজধানী ঢাকার ধানমন্ডি থানা পুলিশ মরদেহের সুরতহাল করেছেন। তাঁদের তত্ত্বাবধানে ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ (ঢামেক) হাসপাতাল মর্গে মরদেহের ময়নাতদন্ত সম্পন্ন হয়েছে। তিনি বলেন, এ বিষয়ে ধানমন্ডি থানা পুলিশ লাকসাম থানায় অবহিত করেছেন। কিন্ত ভিকটিমের পরিবার কিংম্বা মাদ্রাসা কর্তৃপক্ষ আমাদের জানায়নি।
তিনি আরো জানান, ঘটনার ১০দিন পর নিহতের মা শারমিন আক্তার বাদি হয়ে অজ্ঞাত আসামিদের বিরুদ্ধে লাকসাম থানায় একটি হত্যা মামলা দায়ের করেছেন। পুলিশ অত্যন্ত আন্তরিকতার সাথে তদন্ত কার্যক্রম চালাচ্ছেন। মামলার তদন্ত অব্যাহত রয়েছে। এ ছাড়া, ময়নাতদন্তের প্রতিবেদন পেলে মৃত্যুর সঠিক কারণ জানা যাবে এবং প্রয়োজনীয় আইনগত ব্যবস্থা নেওয়া হবে। এ ক্ষেত্রে পুলিশের কোনো ধরণের গাফিলতি নেই।
এই ব্যাপারে কুমিল্লার সহকারী পুলিশ সুপার (এএসপি,লাকসাম সার্কেল) সৌমেন মজুমদার জানান, সংবাদ পেয়ে তিনি ঘটনাস্থল পরিদর্শন করেছেন।
তিনি জানান, এই ঘটনায় পুলিশ অত্যন্ত আন্তরিকতার সাথে এবং সুক্ষ্মভাবে তদন্ত কার্যক্রম পরিচালনা করছেন। তদন্তের কাজ প্রায় ৮০ ভাগ সম্পন্ন হয়েছে। আশা রাখি আশানুরূপ ফলাফল পাবো। তবে তদন্তের স্বার্থে এখন কোনো মন্তব্য করতে চান না তিনি।