আজকের কাগজ

নগদে ডিজিটাল জালিয়াতি: ২৩৫৬ কোটি টাকার হিসাব মিলছে না

নগদে বড় অঙ্কের অর্থ বা ই-মানি তৈরি করা হয়েছে, যার কারণে হিসাব মিলছে না ২ হাজার ৩৫৬ কোটি টাকার। অন্তর্বর্তীকালীন সরকার দায়িত্ব নেওয়ার পর বাংলাদেশ ব্যাংকের নিযুক্ত প্রশাসক ও ব্যবস্থাপনা কমিটির পরিদর্শনে এসব অনিয়মের তথ্য উঠে এসেছে।

অনুমোদনহীন পরিবেশক নিয়োগের দায়ে ছয় কর্মকর্তার একটি তালিকা চূড়ান্ত করে তাঁদের বিরুদ্ধে আইনি ব্যবস্থা নিতে ডাক বিভাগের কাছে পাঠানো হয়েছে। নগদে নিযুক্ত প্রশাসক মুহম্মদ বদিউজ্জামান দিদার এই অনিয়মের সঙ্গে জড়িত ব্যক্তিদের বিরুদ্ধে আইনানুগ ব্যবস্থা নিতে ডাক অধিদপ্তরকে চিঠি দিয়েছেন। এর আগে নগদের শীর্ষ পর্যায়ের পাঁচ কর্মকর্তাকে বরখাস্ত করা হয়েছিল।

নগদে এসব অনিয়মের সময় আওয়ামী লীগের একাধিক সংসদ সদস্য ও প্রভাবশালী ব্যক্তিরা এর পরিচালনায় যুক্ত ছিলেন। কেন্দ্রীয় ব্যাংক ও ডাক অধিদপ্তর বিষয়টি জানলেও নীরব ছিল। প্রশাসকের দলে থাকা কর্মকর্তারা এটিকে দেশের সবচেয়ে বড় “ডিজিটাল জালিয়াতি” হিসেবে চিহ্নিত করেছেন। তাই সিদ্ধান্ত হয়েছে, নগদে ফরেনসিক নিরীক্ষা করা হবে।

কীভাবে জালিয়াতি হয়েছে

ডাক অধিদপ্তর ও থার্ড ওয়েভ টেকনোলজির মধ্যে ২০১৭ সালের চুক্তি অনুযায়ী, ব্যাংকে জমা টাকার সমপরিমাণ ই-মানি ইস্যু করার কথা ছিল। কিন্তু প্রশাসকের পরিদর্শনে দেখা গেছে, অতিরিক্ত ৬৪৫ কোটি টাকার ই-মানি ইস্যু করা হয়েছে। এছাড়া অনুমোদনহীন ৪১টি পরিবেশক হিসাব খোলা হয়েছিল, যার মাধ্যমে ১ হাজার ৭১১ কোটি টাকা বের করে নেওয়া হয়।

সরকারি ভাতা বিতরণের জন্য নগদকে বেছে নেওয়া হয়েছিল। কিন্তু ভাতাভোগীদের টাকা তিন দিনের মধ্যে উত্তোলন না হলে সেই অর্থ তুলে নেওয়া হতো। এমনকি কুমিল্লার পরিবেশকের মাধ্যমে রংপুরের ভাতাভোগীদের টাকা বিতরণ হয়েছে বলেও অভিযোগ রয়েছে।

জড়িতদের তালিকা

এই জালিয়াতির সঙ্গে সংশ্লিষ্ট সন্দেহে ছয় কর্মকর্তার একটি তালিকা তৈরি করা হয়েছে। তারা হলেন—
১. নির্বাহী পরিচালক সাফায়েত আলম
২. অতিরিক্ত ব্যবস্থাপনা পরিচালক মোহাম্মদ আমিনুল হক
৩. উপব্যবস্থাপনা পরিচালক গোলাম মর্তুজা চৌধুরী
৪. প্রধান প্রযুক্তি কর্মকর্তা আবু রায়হান
৫. আর্থিক প্রশাসন বিভাগের প্রধান রাকিবুল ইসলাম
৬. সলিউশন ডিজাইন বিভাগের ফার্স্ট ভাইস প্রেসিডেন্ট নাজমুস সাকিব আকিব।

প্রশাসক বদিউজ্জামান দিদার ডাক অধিদপ্তরের মহাপরিচালককে চিঠিতে জানান, এসব অনিয়ম এবং চুক্তি লঙ্ঘনের বিরুদ্ধে আইনি ব্যবস্থা নেওয়ার অধিকার ডাক বিভাগের রয়েছে।

শুরু থেকেই অনিয়ম

২০১৭ সালে পোস্টাল ক্যাশ কার্ড সেবা চালুর জন্য ডাক অধিদপ্তর ও থার্ড ওয়েভ টেকনোলজির মধ্যে চুক্তি হয়। এতে বলা হয়েছিল, আয়ের ৫১% ডাক বিভাগ ও ৪৯% থার্ড ওয়েভ পাবে। পরবর্তীতে ২০১৯ সালে ‘নগদ’ নামে মোবাইল আর্থিক সেবা চালু করা হয়। কিন্তু বাংলাদেশ ব্যাংক যথাযথ শর্ত পূরণ না হওয়ায় নগদকে কোনো চূড়ান্ত লাইসেন্স দেয়নি।

কারা পেছনে?

থার্ড ওয়েভ টেকনোলজি প্রতিষ্ঠিত হয় ২০১৬ সালে। প্রতিষ্ঠাতাদের মধ্যে ছিলেন তানভীর আহমেদ, কাজী মনিরুল কবির, সৈয়দ মোহাম্মদ কামাল, সৈয়দ আরশাদ রেজা ও মিজানুর রহমান। পরবর্তী সময়ে আওয়ামী লীগের দুই সংসদ সদস্য নাহিম রাজ্জাক ও রাজী মোহাম্মদ ফখরুল মালিকানায় যুক্ত হন।

নগদের দ্রুত বৃদ্ধি এবং সরকারি অনুমোদনের অভাব থাকা সত্ত্বেও এর কার্যক্রম চালিয়ে যাওয়ার পেছনে রাজনৈতিক শক্তি ছিল বলে দাবি করেন অর্থনীতিবিদরা।

এ বিষয়ে অ্যাসোসিয়েশন অব ব্যাংকার্স বাংলাদেশের সাবেক চেয়ারম্যান আনিস এ খান বলেন, “নগদের পেছনে বড় শক্তি থাকায় অনুমতি ছাড়াই এটি এত বড় হয়েছে। এখন গরিব মানুষের হারানো টাকা ফেরত আনতে সরকারকে কঠোর হতে হবে।”

Exit mobile version